Tuesday 19 October 2021

কেউ বুঝল না

কেউ বুঝল না

------‐--------------------

সেকালে স্বামীজীকে একা লড়তে হয়েছিল আর একালেও তাই | তাঁর কাজে বড় কম মানুষ নিজেকে ঠিক ঠিক নিয়োগ করেছেন | তাই স্বামীজী বড়ই একা | তাঁর বাণী না কেউ বোঝার চেষ্টা করেছেন না কেউ কোনকালে তা বুঝেছেন | সহজ নয় সে বাণী যে সহজে হৃদয়ঙ্গম হবে পূর্ণমাত্রায় | যাঁরা তাঁর সমকালীন কৃতি মানুষজন ছিলেন, যেমন রবীন্দ্রনাথ, তাঁরা স্বামীজীর জীবোদ্দশায় তাঁকে না ঠিক চিনতে পেরেছিলেন, না তাঁকে কোনভাবে সাহায্য করেছিলেন | ফলে বরানগর মঠের প্রাথমিক অমানুষিক দারিদ্র |


বিশ্ববরেণ্য বিবেকানন্দকে বোঝার জন্য যে শুধু বিরাট হৃদয় লাগে তা নয় | তাঁকে বোঝার জন্য বিরাট মনীষাও লাগে | তাই তাঁকে প্রায় প্রত্যেকেই আংশিকভাবে বুঝেছিলেন | তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ ব্যতীত হয়ত একমাত্র শ্রীমা সারদাদেবীই তাঁকে পূর্ণরূপে চিনেছিলেন কারণ তাঁরা ছিলেন স্বামীজীর স্বরূপে স্থিত | এটি আধ্যাত্মিক উপলব্ধির বিষয়, তাই এই জটিল তত্ত্বটিতে আর প্রবেশ করছি না |


একজন যথার্থ মানুষ সৃজনশীল হন, চিন্তাবিদ হন, স্বকীয়তার অধিকারী হন | তিনি স্বধর্ম পালন করেন, পরের অনুকরণ করেন না | তাঁর সমাজকে কিছু দেওয়ার থাকে নিজস্ব ধারায় সমাজের অভাব দূরিকরণকল্পে | স্বামীজী ছিলেন এমনই এক ব্যক্তিত্ব |


কিন্তু আরও একটি গুণের জন্য তাঁকে কেউ সেভাবে বোঝেনও নি, তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণও করেন নি | তা হল তাঁর যুগের আগে আগমন | স্বামীজী আগামি যুগের ভাবের, আদর্শের প্রতিষ্ঠাতা, রূপকার ও মূর্তবিগ্রহ | তাঁর চিন্তা সে যুগের ও এ যুগের থেকে এত এগিয়ে যে তা পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করা অসম্ভব সাব্যস্ত হয়েছে |


প্রথমতঃ, স্বামীজীর জটিল ব্যক্তিত্ব, অনেকটা মানবসমাজের প্রতিফলিত রূপ, বিশ্ব ইতিহাসের স্তরে স্তরে সংঘাতের প্রতিফলন, অতীতের চৈতন্যের আধার, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা |

তাঁর চিন্তা এত সার্বিক, এত গভীর, এতই আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী অথচ গভীর মননে পূর্ণ সমন্বিত, সামঞ্জস্যপূর্ন যে স্বল্পবুদ্ধির মানুষ অথবা স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিজীবির দল তাঁকে ঠিক বুঝে উঠতে পারবেন না | তাই দুটি সম্ভাবনা দেখা দেয় | এক, ভক্তিতে বিচারবিহীন আত্মসমর্পণ ও দুই, তাঁর সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ ও বিভ্রান্তি ছড়ানো যে তিনি ইত্যাদি, ইত্যাদি |


দ্বিতীয়তঃ, স্বামীজীর সমাজচেতনার সাথে ধর্মচেতনার বৈদান্তিক দিক দিয়ে কোন সংঘাত না থাকলেও বাস্তব জগতে প্রায়ই ঘটত | এই জন্য তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বিবেকানন্দবোধের সাথে স্বামীজীর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ সংঘের সন্ন্যাসীদের বিবেকানন্দবেধের বিস্তর ব্যবধান থাকাটাই স্বাভাবিক ও কার্যক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে | স্বামীজীর সমাজচেতনার মধ্যে কমিউনিস্টরা মার্ক্সিয় চেতনার ছায়া দেখতে পান যদিও স্বামীজী অধ্যাত্মবাদি ছিলেন মর্মে মর্মে | এবিষয়ে বামপন্থিদের কারো কারো মুখে এমন কথাও শোনা যায় যে স্বামীজী ভারতবর্ষের তৎকালীন ধর্মভিত্তিক সমাজচেতনা দেখে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর মানবমুক্তির পথকে ধর্মভিত্তিক করতে for men may make history but not as they choose to do it. পক্ষান্তরে রামকৃষ্ণ মিশন স্বামীজীর জীবন ও বাণী উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেন যে স্বামীজী মোটেই অধ্যাত্মবাদকে সামাজিক স্বার্থে ব্যবহার করেন নি, বরং তিনি বৈদান্তিক অধ্যাত্মবাদকেই সমাজের আভ্যন্তরীণ সার বলে উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর সাধনার দ্বারা | স্বামীজীকে বোঝার ক্ষেত্রে এই বিভ্রান্তি ঘটেছে তার কারণ বিবেকানন্দের বিরাট বুদ্ধির নাগাল পাননি তাঁর অনুৃধ্যানকারীরা | শুরুতেই বলেছি, জটিল ব্যক্তিত্ব বিবেকানন্দ, সহজ নয় বোঝা | ফলও অনুরূপ হয়েছে | এই সর্বাঙ্গিন বুদ্ধির অভাব থেকেই সম্প্রদায় সৃষ্টি হয় | স্বামীজী বলতেন, সাধারণ মানুষের বুদ্ধি একদেশদর্শী আর ব্রহ্মজ্ঞানীর বুদ্ধি সর্বগ্রাসী | তিনি নিজে ছিলেন মহা ব্রহ্মজ্ঞানী ও তাঁর মনীষা ছিল সর্বগ্রাসী | তাই তাঁকে বুঝতে গিয়ে এত মতান্তর |


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)



No comments:

Post a Comment