Thursday 28 October 2021

যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ৩




যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ৩

-----------------------------------------------------


শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর দিব্য অনুভূতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বললেন, "যত মত, তত পথ |" পৃথিবীর মানুষ শুনল এক নতুন বাণী | রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের সূচনা হল জগতে |


এখন বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হল এই যে 'যত মত, তত পথ' সনাতন ধর্মের তাত্ত্বিক দিক দিয়ে সত্য হলেও ব্যবহারিক দিক দিয়ে তা কতদূর ফলপ্রসূ বিশ্বে আজ, বিশেষতঃ ইসলাম অধিকৃত দেশে ? কতদূর এই উদার বাণীর কার্যকারিতা যখন ইসলামের শাস্ত্রগত মূল নীতি ও তত্ত্ব এই সর্বমত সহিষ্ণুতা ও পরস্পর পরস্পরের ভাবগ্রহণের বিরোধী ? ইসলাম একমাত্র নিজেকেই সর্বোৎকৃষ্ট, নিখুঁত ধর্ম বলে ঘোষণা করে, কুরানকে আল্লাহ্'র বাণী বলে সমস্ত মানবজাতির ওপর বাধ্যতামূলক আরোপ করতে প্রবৃত্ত হয় ও মুহম্মদকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর বলে চিহ্নিত করে | ইসলামের এই বিচারে সনাতন ধর্ম তথা পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম আংশিক অথবা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, হিন্দুধর্মের বিগ্রহপূজা যা শ্রীরামকৃষ্ণ করতেন, তা ভ্রান্ত ও, যেহেতু মুহম্মদ-পরবর্তি আবির্ভাব শ্রীরামকৃষ্ণের, অতএব তিনি সামান্য মানুষমাত্র, পয়গম্বর নন, অবতার তো ননই কারণ ইসলাম অবতারতত্ত্ব মানে না ও আল্লাহ'র আসনে আর কাউকে স্থান দেয় না | কুরান ও হাদীস অনুযায়ী শ্রীরামকৃষ্ণের ইসলাম সাধনা নাজায়েজ্ কারণ তিনি ইসলাম ধর্মে আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মান্তরিত নন, সেই সাধনার পর তিনি পুনঃ বিগ্রহ পূজা করেছেন যা ইসলামে গর্হিত অপরাধ ও তাঁর ইসলাম ধর্মসাধনার পর উপলব্ধি সনাতন ধর্মের সাথে মেলে, কুরানে কথিত তত্ত্বের সাথে বিশেষভাবে নয় |


সনাতন ধর্মের চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক সিদ্ধান্ত অদ্বৈতজ্ঞান | অদ্বৈত অনুভূতিই সনাতন ধর্মের প্রাণ | মুক্তি, মোক্ষ আত্মার সর্বশেষ পরিণতি | ইসলামে এই অদ্বৈতজ্ঞান যা ব্রহ্মজ্ঞান অথবা আত্মজ্ঞানরূপেও কথিত, তার কোনো উল্লেখ নেই | এ তত্ত্ব ইসলামের অবিদিত যদিও আনাল হক্ বলে এর নামান্তরের কথা আমরা শুনতে পাই ইসলামী ইতিহাসে যার প্রবক্তাকে অনঐসলামীক তত্ত্বপেশের জন্য নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল |


অতএব, তিনদিনের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ যদিও সুফি মুসলিম গোবিন্দ রায়ের দীক্ষিত 'আল্লা' মন্ত্র জপ করেছিলেন ও ইসলামধর্মের চূড়ান্ত সাধনফল লাভ করেছিলেন বলে 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গে' বর্ণিত আছে, সেই সাধনফল আসলে কি এবং তা আদপে আদি ইসলামের সাথে মেলে কি না ? না কি তা সনাতন ধর্মের আধ্যাত্মিক তত্ত্বের সাথে মেলে ? লীলাপ্রসঙ্গ থেকেই দেখে নেওয়া যাক | নিম্নে উদ্ধৃত হল 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ' কি বলছেন এ বিষয়ে |

--------------------------------------------------


শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ

দ্বিতীয় খণ্ড - ষোড়শ অধ্যায়: বেদান্তসাধনের শেষ কথা ও ইসলামধর্মসাধন

----------------------------------------------------


অদ্বৈতবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত ঠাকুরের মনের উদারতা সম্বন্ধে দৃষ্টান্ত - তাঁহার ইসলাম ধর্মসাধন

---------------------------------------------------


অদ্বৈতবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হইয়া ঠাকুরের মন এখন কিরূপ উদারভাবসম্পন্ন হইয়াছিল, তাহা আমরা এই কালের একটি ঘটনায় স্পষ্ট বুঝিতে পারি। আমরা দেখিয়াছি, ঐ ভাবসাধনে সিদ্ধ হইবার পরে ঠাকুরের শরীর কয়েক মাসের জন্য রোগাক্রান্ত হইয়াছিল। সেই ব্যাধির হস্ত হইতে মুক্ত হইবার পরে উল্লিখিত ঘটনা উপস্থিত হইয়াছিল।


গোবিন্দ রায় নামক এক ব্যক্তি এই সময়ের কিছুকাল পূর্ব হইতে ধর্মান্বেষণে প্রবৃত্ত হন। হৃদয় বলিত, ইনি জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন। সম্ভবতঃ পারসী ও আরবী ভাষায় ইঁহার ব্যুৎপত্তি ছিল। ধর্মসম্বন্ধীয় নানা মতামত আলোচনা করিয়া এবং নানা সম্প্রদায়ের সহিত মিলিত হইয়া ইনি পরিশেষে ইসলামধর্মের উদার মতে আকৃষ্ট হইয়া যথারীতি দীক্ষাগ্রহণ করেন। ধর্মপিপাসু গোবিন্দ ইসলামধর্মমত গ্রহণ করিলেও উহার সামাজিক নিয়মপদ্ধতি কতদূর অনুসরণ করিতেন, বলিতে পারি না। কিন্তু দীক্ষাগ্রহণ করিয়া অবধি তিনি যে কোরানপাঠ এবং তদুক্ত প্রণালীতে সাধনভজনে মহোৎসাহে নিযুক্ত ছিলেন, একথা আমরা শ্রবণ করিয়াছি। গোবিন্দ প্রেমিক ছিলেন। বোধ হয়, ইসলামের সুফী সম্প্রদায়ের প্রচলিত শিক্ষা এবং ভাবসহায়ে ঈশ্বরের উপাসনা করিবার পদ্ধতি তাঁহার হৃদয় অধিকার করিয়াছিল। কারণ ঐ সম্প্রদায়ের দরবেশদিগের মতো তিনি এখন ভাবসাধনে অহোরাত্র নিযুক্ত থাকিতেন।


সুফি গোবিন্দ রায়ের আগমন

------------------------‐-----


যেরূপেই হউক, গোবিন্দ এখন দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে উপস্থিত হয়েন এবং সাধনানুকূল স্থান বুঝিয়া পঞ্চবটীর শান্তিপ্রদ ছায়ায় আসন বিস্তীর্ণ করিয়া কিছুকাল কাটাইতে থাকেন। রানী রাসমণির কালীবাটীতে তখন হিন্দু সংসারত্যাগীদের ন্যায় মুসলমান ফকিরগণেরও সমাদর ছিল এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের ত্যাগী ব্যক্তিদিগের প্রতি এখানে সমভাবে আতিথ্য প্রদর্শন করা হইত। অতএব এখানে থাকিবার কালে গোবিন্দের অন্যত্র ভিক্ষাটনাদি করিতে হইত না এবং ইষ্টচিন্তায় নিযুক্ত হইয়া তিনি সানন্দে দিনযাপন করিতেন।


গোবিন্দের সহিত আলাপ করিয়া ঠাকুরের সঙ্কল্প

--------------------------------------------------


প্রেমিক গোবিন্দকে দেখিয়া ঠাকুর তৎপ্রতি আকৃষ্ট হয়েন এবং তাঁহার সহিত আলাপে প্রবৃত্ত হইয়া তাঁহার সরল বিশ্বাস ও প্রেমে মুগ্ধ হয়েন। ঐরূপে ঠাকুরের মন এখন ইসলামধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তিনি ভাবিতে থাকেন, 'ইহাও তো ঈশ্বরলাভের এক পথ, অনন্ত-লীলাময়ী মা এপথ দিয়াও তো কত লোককে তাঁহার শ্রীপাদপদ্মলাভে ধন্য করিতেছেন; কিরূপে তিনি এই পথ দিয়া তাঁহার আশ্রিতদিগকে কৃতার্থ করেন, তাহা দেখিতে হইবে; গোবিন্দের নিকট দীক্ষিত হইয়া এ ভাবসাধনে নিযুক্ত হইব।'


গোবিন্দের নিকট হইতে দীক্ষাগ্রহণ করিয়া সাধনে ঠাকুরের সিদ্ধিলাভ

----------------------‐---------------------------


যে চিন্তা, সেই কাজ। ঠাকুর গোবিন্দকে নিজ অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন এবং দীক্ষাগ্রহণ করিয়া যথাবিধি ইসলামধর্মসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। ঠাকুর বলিতেন, "ঐ সময়ে 'আল্লা'-মন্ত্র জপ করিতাম, মুসলমানদিগের ন্যায় কাছা খুলিয়া কাপড় পরিতাম; ত্রিসন্ধ্যা নমাজ পড়িতাম এবং হিন্দুভাব মন হইতে এককালে লুপ্ত হওয়ায় হিন্দু দেবদেবীকে প্রণাম দূরে থাকুক, দর্শন পর্যন্ত করিতে প্রবৃত্তি হইত না। ঐভাবে তিন দিবস অতিবাহিত হইবার পরে ঐ মতের সাধনফল সম্যক হস্তগত হইয়াছিল।" ইসলামধর্মসাধনকালে ঠাকুর প্রথমে এক দীর্ঘশ্মশ্রুবিশিষ্ট, সুগম্ভীর, জ্যোতির্ময় পুরুষপ্রবরের দিব্যদর্শন লাভ করিয়াছিলেন। পরে সগুণ বিরাট ব্রহ্মের উপলব্ধিপূর্বক তুরীয় নির্গুণ ব্রহ্মে তাঁহার মন লীন হইয়া গিয়াছিল।


মুসলমানধর্মসাধনকালে ঠাকুরের আচরণ

-------------------------------------------


হৃদয় বলিত, মুসলমানধর্মসাধনের সময় ঠাকুর মুসলমানদিগের প্রিয় খাদ্যসকল, এমন কি গো-মাংস পর্যন্ত গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক হইয়াছিলেন। মথুরামোহনের সানুনয় অনুরোধই তখন তাঁহাকে ঐ কর্ম হইতে নিরস্ত করিয়াছিল। বালকস্বভাব ঠাকুরের ঐরূপ ইচ্ছা অন্ততঃ আংশিক পূর্ণ না হইলে তিনি কখনও নিরস্ত হইবেন না ভাবিয়া মথুর ঐ সময়ে এক মুসলমান পাচক আনাইয়া তাহার নির্দেশে এক ব্রাহ্মণের দ্বারা মুসলমানদিগের প্রণালীতে খাদ্যসকল রন্ধন করাইয়া ঠাকুরকে খাইতে দিয়াছিলেন। মুসলমানধর্মসাধনের সময় ঠাকুর কালীবাটীর অভ্যন্তরে একবারও পদার্পণ করেন নাই। উহার বাহিরে অবস্থিত মথুরামোহনের কুঠিতেই বাস করিয়াছিলেন।


ভারতে হিন্দু ও মুসলমান জাতি কালে ভ্রাতৃভাবে মিলিত হইবে, ঠাকুরের ইসলামমত-সাধনে ঐ বিষয় বুঝা যায়

-----------------------------------------------


বেদান্তসাধনে সিদ্ধ হইয়া ঠাকুরের মন অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি কিরূপ সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়াছিল, তাহা পূর্বোক্ত ঘটনায় বুঝিতে পারা যায় এবং একমাত্র বেদান্তবিজ্ঞানে বিশ্বাসী হইয়াই যে ভারতের হিন্দু ও মুসলমানকুল পরস্পর সহানুভূতিসম্পন্ন এবং ভ্রাতৃভাবে নিবদ্ধ হইতে পারে, একথাও হৃদয়ঙ্গম হয়। নতুবা ঠাকুর যেমন বলিতেন, "হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যেন একটা পর্বত-ব্যবধান রহিয়াছে - পরস্পরের চিন্তাপ্রণালী, ধর্মবিশ্বাস ও কার্যকলাপ এতকাল একত্রবাসেও পরস্পরের নিকট সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য হইয়া রহিয়াছে।" ঐ পাহাড় যে একদিন অন্তর্হিত হইবে এবং উভয়ে প্রেমে পরস্পরকে আলিঙ্গন করিবে, যুগাবতার ঠাকুরের মুসলমানধর্মসাধন কি তাহারই সূচনা করিয়া যাইল?

-----------------------------------------------


তৃতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment