Monday 11 October 2021

ছুটি কিসের ?


ছুটি কিসের ?

------------‐-----


কোন কারণেই কাজ বন্ধ করা উচিত নয় | কর্মই জীবন | আলস্যের, অবসরের সময় পাওয়া যাবে কতক মৃত্যুর পর | এখন তো কাজ করে নি | কারণ কাজ করতেই তো পৃথিবীতে এসেছি | কর্ম নিষ্কাম হলে চিত্ত শুদ্ধ হবে | চিত্ত নির্মল হলে সেই নিস্তরঙ্গ স্বচ্ছ চিৎসমুদ্রে ব্রহ্ম প্রতিফলিত হবেন, এমনই স্বামীজী বলেছেন | তাই তিনি কাজের ওপর এত জোর দিয়েছেন |


কর্ম নিজরক্ষার্থে, পরহীতার্থে, সকল প্রাণীর ব্রহ্মাভিমুখে গমনহেতু করণীয় | কর্ম বন্ধ হল বাহ্যিকভাবে তো তমোগুণে পতিত হল জীব, মৃত্যু যার চূড়ান্ত পরিণতি | কর্ম সঠিকভাবে করতে করতে ব্রহ্মদর্শন, কৈবল্যপ্রাপ্তি | তখন আর কর্ম রইল না | কিন্তু সেই নৈষ্কর্মে পৌঁছনোর আগে নিরন্তর নিষ্কাম কর্ম করার প্রয়াস পেতে হবে |


কর্মের দ্বারা মনঃসংযম হয়, চিন্তা সুপরিচালিত, পরিচ্ছন্ন হয়, আত্মবিশ্বাস বর্ধিত হয় ও ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ ঘটে | মানুষ সুসংহত হন যথোচিত কর্ম সম্পাদনের দ্বারা | সমাজসঞ্চালনে, লোকসংগ্রহার্থে তাঁর অবদান বিশিষ্টতা লাভ করে | সর্বোপরি কর্ম মানুষকে আত্মসাক্ষাৎকারের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় | তাই কর্মই ধর্ম, এর কোন বিকল্প নেই |


সত্ত্ব, রজো আর তমো -- এই তিন গুণে ব্রহ্মাণ্ড বিধৃত | এদেরই গাণিতিক নানা যোগে সর্বকর্ম সম্পাদিত হচ্ছে | তমোগুণে কর্মবিমুখতা, আলস্য, কপটাচার, ক্রুড়তা, মিথ্যাচার, অবক্ষয়, ধ্বংস ইত্যাদি হয় | রজোগুণে কর্মপ্রবণতা, রাজকীয়তা, অহংকার, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, দানশীলতা, সম্প্রসারণ, অস্থিরতা ইত্যাদির প্রকাশ হয় | সত্ত্বগুণে শান্ত স্বভাব, জ্ঞান, প্রেম, সচ্চিন্তা, ঈশ্বপরায়ণতা, সূক্ষ্মবুদ্ধি, অমায়িকতা, নির্মল স্বভাব, পবিত্রতা, নির্লোভ, অক্রোধ, ক্ষমাশীলতা, বাকসংযম, খাদ্যসংযম, ধ্যানপরায়ণতা, অন্তর্মুখীনতা, আত্মচিন্তা ইত্যাদি নানা সদগুণাবলীর বিকাশ হয় | 


প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই তিন গুণের সমাহার নানান পরিমাণে | যাঁর মধ্যে সত্ত্বগুণ বেশী তিনি সত্ত্বগুণী, যাঁর প্রকৃতিতে রজোগুণের আধিক্য তিনি রজোগুণী আর যিনি তমোপ্রধান তিনি তমোগুণী | দেশের ক্ষেত্রেও তাই | যে দেশের মানুষ অধিকাংশই শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক, কুসংস্কারমুক্ত ও কর্মতৎপর, সে দেশ রজোগুণী | যে দেশের বেশীর ভাগ মানুষ অশিক্ষা, অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের কবলে, সে দেশ তমোগুণী | সর্বশেষ, যে দেশের মানুষ অধিকাংশই ধর্মপরায়ণ, অহিংস, উচ্চমনা, আত্মনিষ্ঠ, শাস্ত্রনিষ্ঠ, অন্তর্মুখীন, বৈরাগ্যবান, সে দেশ সত্ত্বগুণী | এমন দেশ জগতে নেই | ভারতবর্ষ এই অবস্থার কাছাকাছি একদিন পৌঁছেছিল তাঁর সভ্যতার স্বর্ণযুগে | তবুও তা সার্বিকভাবে সত্ত্বগুণ থেকে অনেকটাই দূরে ছিল |


মানুষের মন স্থিতিশীল নয় | তাঁর চিত্ত চঞ্চল | বিষয়াঘাতে তাতে আন্দোলন হয়েই চলে | এই চঞ্চলতাহেতু মন কখনও ঊর্দ্ধমুখী, কখনও নিম্নমুখী হয় | সাথে সাথে তার গুণগত পরিবর্তনও হতে থাকে | যে মানুষের মন অধিকাংশ সময়েই সত্ত্বগুণ অবলম্বন করে থাকে, তিনি সত্ত্বগুণী | একই ভাবে রজোগুণী ও তমোগুণী হয়ে থাকেন মানুষ |


আর এক শ্রেণীর মানুষ আছেন যাঁরা জীবনমুক্ত | তাঁরা কোন গুণের বশবর্তী নন | তাঁরা ত্রিগুণাতীত |


সকল প্রকার গুণবিশিষ্ট মানুষই কিন্তু কর্ম করতে বাধ্য | একমাত্র নির্বিকল্প সমাধির অবস্থায় যখন নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়, বিষয়চিন্তা স্তব্ধ হয়ে যায়, তখনই কর্ম বন্ধ হয় | এ অবস্থা বিরল ও সাধারণে অগম্য | একমাত্র সমাধিবান মহাপুরুষই মনকে সংযমের দ্বারা বৃত্তিশূণ্য করে কর্মের শৃঙ্খল ভাঙতে পারেন | বাকি সবাই কর্মে বদ্ধ | তাঁদের কর্ম দ্বারাই সম্ভব কর্মাতীত ভূমিতে ক্রমশঃ উত্থানের | তাই কর্মই ধর্ম | 


এই সহজ সত্যটি কিন্তু অতি সহজেই মানুষ ভুলে যান | তাই ক্ষুধাতৃষ্ণারূপ বৃত্তিগুলি তাঁকে বাধ্য করে জীবনরক্ষার্থে কিছু অত্যাবশ্যক কর্ম করতে | মূল কর্মের এই অপরিহার্যতা না থাকলে মানুষ কর্মই করত না | তাই সম্ভবত জীবসৃষ্টির এই বিধান | 


মানুষের এই জীবনরক্ষার্থে কর্ম পশুপ্রায় | মনুষ্যত্বের বিকাশ চিন্তায়, জিজ্ঞাসায়, প্রয়োজনকে ছাপিয়ে বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করায় | শিক্ষা এর উপায় | এর কারণ মানুষের মস্তিষ্ক অতি নমনীয় | তাকে পরিবর্তিত করা যায় তথ্য দ্বারা, পরিবর্ধিত করা যায় উপযুক্ত শিক্ষার দ্বারা | মানুষের স্নায়তন্ত্রও একই ভাবে শিক্ষার দ্বারা, যৌগিক প্রক্রিয়ার দ্বারা পরিশুদ্ধ, পরিমার্জিত, পরিবর্তিত, বিবর্তিত করা যায় | শিক্ষা ও যোগ হল বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করার উপায় | তাই যে কর্ম মানুষ করে তা সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত পশুর থেকে পৃথক ও প্রকৃতিকে পরাস্ত করার জন্য অপরিহার্য | প্রকৃতি জীবের জন্ম দেন যেমন তেমনই জীবকে ধ্বংসও করেন মৃত্যু দ্বারা | এই মৃত্যুকে রোধ করে স্বীয়স্বরূপে বিরাজ করাই জীবনের উদ্দেশ্য | তাই প্রকৃতির সাথে আপস নয়, প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাই হল মানুষের কর্মের মূল প্রেরণা, প্রয়োজনীয়তা, উদ্দেশ্য ও সার্থকতা | অতএব, আলস্য পরিহার্য অবশ্যই |


ভারতবর্ষে বৈদিক যুগেই এই ব্রহ্মতত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়ে গেছে যার সম্যক উপলব্ধি দ্বারা মানুষ অমরত্ব লাভ করেন, অর্থাৎ, শরীরমনের নশ্বরতা হতে আত্মারূপে নিজেকে পৃথক করে নিতে সক্ষম হন | এ হল আত্মবিজ্ঞান ও তার লাভে মানুষ মরণশীল, পরিবর্তনশীল, নশ্বর জড়জগত হতে মুক্তি পান | সকল কর্মের মূলতঃ এই প্রেরণা | সময় অল্প, পথ দুর্গম ও লক্ষ্য সুদূরপরাহত | কর্ম তাই নিরন্তর করা চাই পবিত্রতা ও মনঃসংযমসহায়ে নিষ্কামভাবে যাতে সংক্ষিপ্তকালের মধ্যেই লক্ষ্যে পৌঁছনো যায় | 


এ তো গেল কর্মের আদর্শগত ইতিবৃত্ত | ব্যবহারগতভাবেও কর্মসম্পাদন অপরিহার্য | নিজ জীবনে বৈষয়িক স্থিতির জন্যও কর্ম না করে উপায় নেই | জটিল সমাজব্যবস্থা | এর মধ্যে নিজেকে উপযুক্ত করে নেওয়া চাই যাতে যে কোন ব্যক্তিবিশেষ সমাজসঞ্চালনের কোন কাজে যথার্থ লাগেন | নিজ কর্মকুশলতার দ্বারা সমাজের সেবা -- এটি না করতে পারলে তো না জুটবে কাজ, না ভরবে পেট | কর্ম অপরিহার্য | 


অবসরের স্থান কোথায় তাহলে ? কর্ম করলেই প্রাণশক্তির ধ্বংস হয় কতক | তাই মানুষ কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন | প্রাণশক্তি পুনরায় পূর্বাবস্থায় আনতে হলে তাই অবসর চাই যখন কর্মী অন্যভাবে ব্যাপৃত থেকে হৃত প্রাণশক্তি ফিরে পান | বিশ্রামে, ধ্যানে, পানাহারে ও লঘুকালক্ষেপনে প্রাণশক্তির পুনর্জীবন ঘটে | তাই নিদ্রা ও অবসর -- দুইয়েরই প্রয়োজনীয়তা আছে কিন্তু এর নাম করে সাধারণভাবে কর্মবিমুখতাকে প্রশ্রয় দেওয়া অনুচিত | মিথ্যার আশ্রয়, মায়ার আশ্রয় নিয়ে, কপটতা করে কর্তব্য হতে বিরত থাকা কখনই কাম্য নয় |


এখন প্রশ্ন হল কর্ম যখন জীবনচালনা ও আত্মোন্নতির জন্য এতই অপরিহার্য তখন কর্ম হতে যথেচ্ছ সাময়িক বিরতিগ্রহণ নানান অজুহাতে ধর্মাচরণ কিনা | ধর্মের নানা উৎসব, অনুষ্ঠান লেগেই আছে ও তার প্রতিটিকে কেন্দ্র করে চলেছে কাজ থেকে ছুটি নেওয়া | এর দ্বারা সমাজের প্রভূত ক্ষতি হয় এবং যেহেতু সমাজ ব্যক্তিবিশেষেরই সমষ্টি, তাই ব্যক্তিমাত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হন এর দ্বারা |


এক মহা অব্যবস্থা চলে আসছে সমাজে যা দিনে দিনে ভীষণাকার ধারণ করছে | মানুষ অন্ধের ন্যায় পথ চলেছে মূঢ়তাকে অবলম্বন করে | ছোটবেলা থেকেই ভুল বিষয়ে জোর দেওয়া হয় | ধর্মোৎসবের নামে, দেশনায়কদের জন্মোৎসব উপলক্ষে, স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস ও মে দিবস উপলক্ষে ছুটি দেওয়া হয় | তাছাড়া গণতান্ত্রিক মতদান দিবস ও রাজনৈতিক দলগুলির ডাক দেওয়া 'কর্মবিরতি দিবস' অথবা 'বন্ধ' তো লেগেই আছে | শেষেরটি বেআইনি | সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অবাধে অমান্য করে দেশজুড়ে এই 'বন্ধ' পালন করা হয় নির্লজ্জভাবে | সাধারণ মানুষ প্রাণভয়ে কাপুরুষের ন্যায় অথবা অলস জীবনযাপনে অভ্যস্ত বলে এইসব দিনে কর্মবিরতি নেয় |


প্রতিটি ছুটির দিনে তমোগুণকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় | মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য না হলেও বেশীরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য | যাঁরা উৎসবপালনতহেতু সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মে ব্যস্ত থাকেন, তাঁরা দেশের, জাতির ঐতিহ্য বহন করে থাকেন একপ্রকার ও সেইহেতু রজোগুণের প্রকাশক হন | কিন্তু যাঁরা উৎসব পালনের নামে আলস্যে দিন কাটান, তাঁরা তমোগুণে পতিত হন এই সকল দিনে | 


আজ পর্যন্ত মানুষ অতি অব্যবস্থার মধ্য দিয়েই চলে এসেছেন | সভ্যতার মূল্য দিয়েছেন অগণিত দরিদ্র জনসাধারণ | তাঁদের শ্রমে তৈরি হয়েছে সভ্যতার সৌধ | তাঁদের ক্লেশে, শরীরের নির্যাতনে গঠিত হয়েছে সভ্যতার ইমারত | অসংখ্য মানুষের নিদারুণ পরিশ্রমে, যাতনায়, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, বঞ্চনায়, রক্তপাতে আবির্ভূত হয়েছে মানুষের সভ্য সমাজ ও তাঁর জীবন নির্বাহের নানা উপকরণ, তাঁর সংস্কৃতি, শিল্প, স্থাপত্য, প্রযুক্তি | এই অব্যবস্থা আজও চলেছে মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও তৎপরিণতিস্বরূপ কর্মে গাফিলতিহেতু | এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় নিরন্তর জগৎগঠনমূলক কর্ম করা যাতে সমস্ত মানবজাতি ও মনুষ্যেতর জীব, উদ্ভিদ, পরিবেশ -- এই সবকিছুই সংরক্ষিত হয় | পৃথিবীর বর্তমান সংকটকালে ছুটির অবসর কোথায় ? ধরিত্রী স্বয়ং তো ছুটি নেননি এখনও | তিনি তো নিরন্তর তাঁর পরিবেশের অসাম্যের প্রতিষেধকরূপে নানা প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব করছেন | তবে আমরা কেন নিষ্কর্মার ন্যায় হাত গুটিয়ে বসে থাকব ? আমাদেরও কর্তব্য প্রবল বিক্রমে পরিবেশের সমস্যা মেটানো ও বিশ্বের অগণিত মানুষের ভরণপোষণের ও জীবিকা নির্বাহের সুব্যবস্থা করা | তাই আজ কাজের দিন, ছুটির দিন নয় | জীবনান্তে ছুটি তো ওমনিই পাব | তখন ছুটিই ছুটি | আজ কাজ করে নি |


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment