Saturday 30 October 2021

যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ৫


যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ৫

--------------------------------------------------


পবিত্রজন কাপুরুষ হন না | কাপুরুষ পবিত্র হন না | এটি এক স্বতঃসিদ্ধ সত্য | ভক্তির আড়ালে ভয় থাকলে ঠাকুরের ভক্ত হওয়া যায় না কারণ তিনি বলেছেন, "লজ্জা, ঘৃণা, ভয় -- এ তিন থাকতে নয় |" সত্যস্বরূপ ঠাকুর নির্ভীক নরেন্দ্রকে তাই তাঁর বার্তাবহরূপে এনেছিলেন কারণ তিনি জানতেন জগতে সনাতন সত্য প্রচার ও লোকমানসে তা প্রতিষ্ঠা করতে একমাত্র অকুতোভয়, সত্যনিষ্ঠ, জিতেন্দ্রিয় পুরুষই পারেন | এ কর্ম ভীরু কাপুরুষের নয়, প্রতিষ্ঠিত মিথ্যার সাথে আপোসকারীর নয় |


সাধুজনের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতীর বিনাশ ও ধর্মসংস্থাপনের জন্য অবতারের আবির্ভাব ঘটে | এ সহজসাধ্য মিশন নয় যে সাধারণ মানুষে সংসাধন করবেন | এ যুগপরিবর্তনের মহাযজ্ঞ | তাই মহাশক্তির প্রকাশ দিব্য অবতরণে | সত্য ও শক্তি -- এই দুইয়ের যুগ্ম অবস্থান অবতার-আধারে | রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সেই যুগ্মগুণের যৌথপ্রকাশ | শ্রীরামকৃষ্ণকে যদি দেবমানবদেহে সত্যের প্রতিভূ বলা যায়, তো স্বামী বিবেকানন্দকে মহাশক্তির বিকিরণকেন্দ্র বলা চলে |


অতএব, সত্য ও শক্তি -- এই দুটি হল মুখ্য উপাদান অবতারলীলায় ; সত্যপ্রতিষ্ঠা শক্তিসহায়ে | কিন্তু ইতিহাস তো বিবর্তনসাপেক্ষ, ইচ্ছামত গড়া যায় না | তাই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে কর্ম করতে হয় | এইখানেই এসে পড়ে আপোস | আর যদি মনুষ্যসমাজের অবস্থান্তর ঘটাতে খোদ অবতারকেই পরিস্থিতির সাথে কতকটা মানিয়ে কর্মসম্পাদন করতে হয় তো তৎপরবর্তি তাঁর অনুগামীদের কা কথা ? তাঁরা কেমন করে জগতের এই জতুগৃহে অকপট সত্যভাষণ করবেন যেখানে সামান্যতম বাকস্ফুলিঙ্গে মুহূর্তমাত্রে দাবানল জ্বলে উঠতে পারে সমাজের বুকে ? কেমন করে তাঁরা বর্বর সমাজে সেই বর্বরতার আদি কারণ জ্ঞাপন করবেন সর্বসমক্ষে ভীষণ অগ্নিসংযোগ না করে ? যে বর্বরতা তলোয়ারের আগায় প্রচারিত হয়েছিল অগণিত মানুৃষের শোণিতস্নানে শত শত বর্ষ ধরে, যা তাঁদের ধমনীতে আজ বহমান নিত্যস্মৃত অসহিষ্ণু, হিংসাত্মক ভাবরূপে, কেমন করে তার বজ্রবাহুর পেষণ হতে মানুষকে নিষ্কাশিত করবেন অবতারের অনুগামীরা স্বল্পসত্যের মৃদুসম্ভাষণের দ্বারা ?


অপশক্তির মোকাবিলা তো শুভশক্তির বলিষ্ঠ প্রয়োগই পারে করতে, মৃদুভাষণের তো তা কর্ম নয় | সুতরাং, জগতের জটিল পরিস্থিতিতে যেমন যথেচ্ছ বাক্যপ্রয়োগের দ্বারা সংঘাত বাড়বে বই কমবে না, তেমনই সত্যগোপনের দ্বারাও সমস্যার সমাধান হবে না | উপায় সুখপ্রদ মধ্যপন্থা অবলম্বনও নয় | উপায় সত্যজ্ঞাপন প্রিয় করে, মিথ্যার শুভ্রবস্ত্রে বর্বরতার কলুষকে আবৃত করার প্রচেষ্টায় নয় | উপায় বর্বরতার সত্যকে ধীর পদক্ষেপে অনাবৃত করা ঐতিহাসিক সত্য বিবরণের মধ্য দিয়ে | উপায় বর্বর তত্ত্বের আকর গ্রন্থপাঠ, তার সম্বন্ধে সম্যক পরিচিতি ও তার সুশিক্ষিত, রুচিসম্পন্ন, মার্জিত প্রচার গণমাধ্যমে সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে | আর সর্বোপরি উপায় এই মিথ্যাভাষণ বন্ধ করা যে ও তত্ত্ব বর্বরতা তো নয়, ও দিব্যপুরুষের দিব্যপ্রেমের দিব্যতত্ত্ব মানুষের উদ্ধারকল্পে | বৈরীভাবাপন্ন সম্প্রদায়ের সাথে যথার্থ সম্প্রীতি বেদান্তসত্যের যথার্থ ভিত্তিভূমির ওপরই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কালক্রমে, তাঁদের ধর্মান্ধতাকে ভ্রাতৃত্বের নাম দিয়ে নয় | মিথ্যার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী এবং তাই ঘটছে তাঁদের সাথে যাঁরা বর্বরতাকে ঢাকছেন অনৃতভাষণের দ্বারা | তাই হিন্দুর আজ এই হাল, এই চূড়ান্ত বিপর্যয় মুসলমানের হাতে পদে পদে যেখানেই সে সংখ্যালঘু |


পঞ্চম অধ্যায়ের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment