Friday 29 October 2021

যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ৪


যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ৪

--------------------------------------------------


শ্রীরামকৃষ্ণ ও তৎপূর্ববর্তী ভারতীয় মুনিঋষিরা সনাতন ধর্মের যে উচ্চ আধ্যাত্মিক আদর্শ জগতে স্থাপন করেছেন তা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যযুগের ধর্মমতগুলির মধ্যে পাওয়া যায় না | এব্রাহ্যাম সূচিত জুডীয়ধর্ম (Judaism), যীষুখ্রীষ্ঠ প্রবর্তিত খ্রীষ্ঠধর্ম (Christianity) ও মুহম্মদ প্রচারিত ইসলামধর্ম (Islam) -- এই তিনটি ধর্মেই ব্রহ্মজ্ঞান, আত্মজ্ঞান, মোক্ষ, মুক্তি, নির্বাণ, অনাহত ওঁঙ্কারধ্বনি, কর্মবাদ, পুনর্জন্ম, ষড়চক্র, সপ্তভূমি, কুলকুণ্ডলিনীশক্তি ইত্যাদি তত্ত্বের কোনও উল্লেখ নেই | মধ্যপ্রাচ্যের এই তিনটি ধর্মকে সেমিটিক ধর্ম (Semitic Religions) ও এব্রাহ্যামিক ধর্ম (Abrahamic Religions) বলা হয় | বর্তমান আলোচনা সীমিত রাখব শুধু ইসলামধর্মের মধ্যে |


শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলামধর্ম সাধন করে সিদ্ধিলাভ করলেন | সে সিদ্ধি মাত্র তিন দিনে সিদ্ধ হল কারণ তাঁর ক্ষেত্র ছিল অধ্যাত্মসিদ্ধির জন্য প্রস্তুত | অদ্বৈতজ্ঞানলাভের পর দ্বৈতভূমিতে নেমে এসে এ সাধনা | তাই আন্তরিক হলেও, অনায়াস | কিন্তু কি সেই সিদ্ধির উপলব্ধি ?


'ইসলামধর্মসাধনকালে ঠাকুর প্রথমে এক দীর্ঘশ্মশ্রুবিশিষ্ট, সুগম্ভীর, জ্যোতির্ময় পুরুষপ্রবরের দিব্যদর্শন লাভ করিয়াছিলেন। পরে সগুণ বিরাট ব্রহ্মের উপলব্ধিপূর্বক তুরীয় নির্গুণ ব্রহ্মে তাঁহার মন লীন হইয়া গিয়াছিল।' -- [ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ ]


কুরানে বর্ণিত আল্লার সাথে কি সনাতন ধর্মের সগুণ তথা নির্গুণ ব্রহ্মের কোনও সাদৃশ্য আছে ? হিন্দু তাঁর বদান্যতাহেতু সাদৃশ্য খোঁজেন কিন্তু মুসলমান তা মানেন না | অতএব, বহিরাঙ্গ দৃষ্টি দিয়ে দেখলে বলা যেতে পারে যে শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলামধর্ম সাধন করে যে আধ্যাত্মিক অনুভূতিস্বরূপ ফললাভ করলেন তা সনাতন ধর্মেরই দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈতবাদের অনুভূতি | শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মবুদ্ধি অবৈদিক ধর্মমতগুলির মধ্যেও সনাতন ধর্মের সত্যকেই পেয়েছিল যা আদপে ওসব অবৈদিক ধর্মের আকর গ্রন্থের অন্তর্গত তত্ত্বের সাথে মেলে না |


শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতার চিড়িয়াখানায় সিংহ দেখে তাঁর দেবীদূর্গার বাহনের কথা স্মরণ হওয়ায় দেবীর ভাবে সমাধিস্থ হন | একই ভাবে ময়দানে ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান ইংরেজ কিশোরকে দেখে ত্রিভঙ্গমুরারি শ্রীকৃষ্ণের স্মরণে তিনি সমাধিস্থ হন | এরকম অজস্র অবস্থায় তিনি সমাধিস্থ হন জীবনে | সমাধিস্থ হওয়া তাঁর কাছে ছিল নিশ্বাসপ্রশ্বাসের ন্যায় সহজসিদ্ধ | উপরোক্ত দুই ঘটনার উদাহরণ থেকে কি আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হব তাহলে যে শ্রীরামকৃষ্ণ 'সিংহধর্ম' ও 'ইংরেজধর্ম' পালন করেছিলেন ও ঐ দুই ধর্মে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধিলাভ করে তার যাথার্থ প্রমাণ করেছিলেন ? নাকি আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হব যে ভাবমুখে অবস্থিত শ্রীরামকৃষ্ণ যে কোনও বস্তু হতেই উদ্দীপিত হয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ সনাতন ধর্মবোধেই ফিরে গেছেন ও সনাতন ধর্মের যাথার্থেরই প্রমাণ রেখেছেন তাঁর সর্ব অনুভূতি ও উপলব্ধির দ্বারা ?


অর্থাৎ, শ্রীরামকৃষ্ণের একটি সুফী সম্প্রদায়ের সাধনপ্রণালী অবলম্বন করে সাধনা ও সিদ্ধিলাভ কি আদি ও অপরিবর্তিত কুরানভিত্তিক ইসলামের তত্ত্বগত অথবা ব্যবহারগত যাথার্থ কোনোভাবে প্রমাণ করে ? মৃত্যুর পর না তিনি কোনও কবরে গোর হলেন না কোনও আল্লা তাঁর পার্থিবকর্মের বিচার করবেন ও সৎকর্মের জন্য জন্নতে ভোগসুখ সম্পাদন করার জন্য স্থান দেবেন বলে আশা করতেন তিনি যিনি ছিলেন নির্বাসনার মূর্ত বিগ্রহ | কলমা পড়ে যদি বা আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলামধর্ম কবুল করেও থাকেন তো তা মোটে তিন দিনের সাধনকালের জন্য ব্যবহারগত অপরিহার্যতাহেতু কিন্তু চতুর্থ দিন হতেই আবার ইসলামে হারাম সেই দেবীবিগ্রহের আরাধনা করেছেন | অর্থাৎ, তিনি ইসলামধর্ম পরিত্যাগ করলেন মাত্র তিনটি দিন তার অধীনে থাকার পরই | যদি কুরানকথিত ইসলাম তত্ত্ব তিনি একান্তই মানতেন চূড়ান্ত সত্য বলে তাহলে তাকে পরিহার করতে পারতেন কি তিনি ? কারণ শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন একান্ত সত্যনিষ্ঠ | তিনি কখনই সত্যকে পরিহার করতে পারতেন না | কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তা ত্যাগের মাধ্যমে তিনি তা অবলীলায় পারলেন | এর থেকে কি প্রমাণ হয় ? ইসলামের দ্বৈতবুদ্ধির আপেক্ষিক সত্যতা ঐ ধর্ম সাধনকালে সাধনার ব্যবহারিক আবশ্যকতাহেতু পূর্ণমনে স্বীকার করে নিলেও শ্রীরামকৃষ্ণ সনাতন ধর্মকেই সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন যা তাঁর উক্ত এই বাণীটিতেই পূর্ণ প্রকাশিত -- "আধুনিক ধর্ম সব আসবে যাবে, এক সনাতন ধর্ম থাকবে | তবে একেবারে যাবে না, ঐ একটু আধটু থাকবে |"


চতুর্থ অধ্যায়ের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment