Wednesday 27 October 2021

যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ২




যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ২

-----------------------------------------------------


বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর মুসলমানকর্তৃক দেশব্যাপী যে অকথ্য অত্যাচার হয়ে চলেছে তাতে রামকৃষ্ণ মিশন দৃপ্ত প্রতিবাদ, মানববন্ধন আয়োজন ও ত্রাণকর্ম করা সত্ত্বেও কোনও কোনও মহলে কথা উঠেছে যে তাঁদের পালিত শ্রীরামকৃষ্ণ কথিত 'যত মত, তত পথ' হিন্দুদের এই দুর্দশার জন্য কতকটা দায়ী | এই অভিযোগ এসেছে যে হিন্দুরাই এই সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী মেনে চলেন, মুসলমানরা তা মানেন না | অতএব, হিন্দুর এই মহাপ্রাণতাই আজ তার দুর্গতির কারণ ও রামকৃষ্ণ মিশন পরোক্ষভাবে অন্ততঃ তার জন্য দায়ী | এই অভিযোগের সত্যাসত্য কতদূর তা নিয়েই আজকের পর্যালোচনা ও আমার এই প্রতিবেদন |


আমি শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীমা সারদা দেবী ও স্বামী বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিতজন | মিশনের বহু প্রাচীন সাধুর স্বল্পাধিক সঙ্গলাভ করেছি ও তাঁদের স্নেহাশীষ পেয়েছি | মিশনের সেবাকর্মের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা সময়ে সম্পৃক্ত থেকেছি | রামকৃষ্ণ মিশনই আমার প্রাণ, আমার আদর্শস্থল ও আমার সহায়, সম্বল, আত্মপরিচয়ের আলোকবর্তিকা | সেই হেতু এই আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে একদিকে যেমন দ্বিধা বোধ করছি, অপর দিকে তেমনই তা কর্তব্য মনে করছি | বিশ্লেষণে ভুল থাকলে নিজগুণে ত্রুটিবিচ্যুতি মার্জনাপূর্বক তা সংশোধন করে দেবেন | এতে সত্য যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে | শ্রীশ্রীঠাকুর আমার এই আলোচনায় সহায় হোন |


শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সাধনকালে সনাতন ধর্মের এক একটি পন্থা অবলম্বন করে পর্যায়ক্রমে সাধন করেন ও সিদ্ধিলাভ করেন | পরিশেষে নিজের আধ্যাত্মিক পিপাসা ও ধর্মবিষয়ক অপার কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য তিনি ইসলাম ও খ্রীষ্ঠধর্ম সাধন করেন এবং যথারীতি সিদ্ধিলাভ করেন | এরপর তিনি তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি করেন যা যুগাবতারের মহামন্ত্ররূপে আজ পরিগণিত | 'যত মত, তত পথ' সেই মহামন্ত্র যা বর্তমানে বাংলাদেশে হিন্দুনিধনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে |


'যত মত, তত পথ' -- এটি তো সনাতন ধর্মেরই শাশ্বত বাণী যা এযুগে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে সাধনরূপে ও বাণীরূপে মূর্ত হয়েছে | এখন প্রশ্ন হল ইসলাম ও খ্রীষ্ঠধর্ম এ বাণী মানে কি না ? তাদের ধর্মগ্রন্থে নিজধর্ম ভিন্ন অন্য কোনও ধর্মকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি | বর্তমান রচনায় বাংলাদেশের হিন্দু নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু ইসলাম ও তার প্রবল সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার কথাই আলোচ্য রাখব 'যত মত, তত পথ' এই বাণীর সংযোগে | 


শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সুফি ইসলাম গুরু গোবিন্দ রায়ের কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন ও সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন কিন্তু ইসলাম ধর্মে প্রথাগতভাবে নিজে ধর্মান্তরিত হন নি | এ ভারী অদ্ভূত ব্যাপার, ইসলাম ধর্মের বিরোধী এক একক অবস্থান ! কেমন করে তিনি ঐ ধর্ম সাধন করলেন তাঁর মুসলমান গুরুর কাছে নিজের হিন্দু ধর্ম ত্যাগ না করে ও ইসলামকে চিরকালের জন্য কুবুল না করে ? আর যদি গোবিন্দ রায় শ্রীরামকৃষ্ণের উচ্চ আধার ও ভাবাবস্থা দেখে সে ব্যবস্থায় রাজী হয়ে তাঁকে ধর্মান্তরিত না করেই সুফি সম্প্রদায়ের ইসলাম সাধনা করাতে সম্মত হন, তাহলে তো শ্রীরামকৃষ্ণ বাহ্যতঃ একটি দিনের জন্যও মুসলমান হননি, বরং বাহ্যতঃ হিন্দু থেকেই সুফি ইসলামের আভ্যন্তরীণ গূঢ় সাধনা করেছিলেন | ব্যবহারিক দিক দিয়ে আজকের সাম্প্রদায়িক বাতাবরণে অসম্ভব বলে মনে হলেও ভারতের ইতিহাসে হয়ত এমন কখনও কখনও হয়ে থাকতে পারে এই রকম ব্যতিক্রম | তাহলে কি শ্রীরামকৃষ্ণের ইসলাম ধর্মে সাধনা ও সিদ্ধিলাভ বাতিল হয়ে গেল ? গৌণ ধর্মাবলম্বীরা তাই বলবেন অবশ্যই কিন্তু মুখ্য ধর্মামবলম্বীরা তা বলবেন না | অতীন্দ্রিয় সত্যলাভ করাই ধর্মের উদ্দেশ্য | শ্রীরামকৃষ্ণের ন্যায় মহাপুরুষের অধ্যাত্ম সাধনার যোগ্যতা ও পরমহংসরূপে তাঁর সমাজের নিয়ম বহির্ভূত হওয়ার কথা গণ্য করেই গোবিন্দ রায় সম্ভবতঃ তাঁকে প্রথাগত নিয়ম না মেনেই দীক্ষা প্রদান করেন ইসলাম ধর্মে এবং ফলতঃ শ্রীরামকৃষ্ণের ইসলাম ধর্মের সোপান বেয়ে অদ্বৈত মহাসাগরে ব্রহ্মানুভূতিই প্রমাণ করে তাঁর ইসলাম ধর্মসাধনার সার্থকতা যদিও তা ইসলাম ধর্মের তত্ত্বগত যাথার্থের প্রমাণ দেয় না | শ্রীরামকৃষ্ণের সাফল্য মানুষের অধ্যাত্ম উপলব্ধির সম্ভাবনাকে জগদ্ব্যাপী বিস্তৃত করে কিন্ত ইসলামের মূল তাত্ত্বিক দর্শনের সত্যাসত্য নিরূপণ করে না |


অবতার তাঁর তুরীয় চেতনার স্তরে অবস্থান করে ধর্ম সম্বন্ধে যে রায় দেন তা কার্যতঃ সর্বসাধারণের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে প্রায়ই প্রয়োগ হয় না | সেখানে ঐক্যের বাণী বিভাজনের রাজনীতিতে পরিণত হয় | তাই এত বিদ্বেষ, বৈষম্য, ব্যভিচার সেই ধর্মের বাহিরমহলে যার অন্দরমহলে প্রবিষ্ট মহাপুরুষ শুধু প্রেমেরই গাথা গেয়ে গেছেন | এখন প্রশ্ন হল এই, শ্রীরামকৃষ্ণ যে ইসলাম ধর্ম সাধন করেছিলেন সেটি কি আদতে ইসলাম ধর্ম যেমনটি কুরানে লিপিবদ্ধ নাকি তিনি সুফি মতাবলম্বী গোবিন্দ রায়ের শিক্ষায় আদত ইসলাম নয়, আদি ইসলামের এক পরিবর্তিত, পরিণত, উন্নত, দরদী ভারতীয় সংস্করণ পালন করেছিলেন ? গোবিন্দ রায় কি তাঁকে আদত, ভয়ানক বিধর্মিবিদ্বেষি, বিধ্বংসী ইসলামের কথা আদপে বলেছিলেন ও সেইমত প্রচলিত হিন্দুধর্মের বিরোধী সব আয়াতের শিক্ষা দিয়েছিলেন ? নাকি গুরুশিষ্যের মধ্যে শুধু ঐ বিশেষ এক সুফি ইসলাম সম্প্রদায়ের সাধনপ্রণালী নিয়েই আলোচনা ও সাধনা সম্পন্ন হয়েছিল ?


দ্বিতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment