Wednesday 17 November 2021

আঁধারের রূপ আছে | নিস্তব্ধতাও কথা বলে। এটা কখনো অনুভব করেছেন ?[স্বামী সোমেশ্বরানন্দ]


-----------------------------------------------------

আঁধারের রূপ আছে | নিস্তব্ধতাও কথা বলে। এটা কখনো অনুভব করেছেন ?

[স্বামী সোমেশ্বরানন্দ]

-----------------------------------------------------


প্রতিক্রিয়া :


বাংলাদেশে হিন্দুগণহত্যায় ভক্তদের নৈঃশব্দ তাই বলছে বটে | এও এক মস্ত আঁধার, নিপীড়নের এক নীরব সমর্থনের বচন |


আঁধারের রূপ আছে বইকি কিন্তু তা দেখার জন্য চেতনার আঁখি প্রয়োজন | কালীর ভয়ঙ্করী রূপ দেখে ভয়ে অচেতন যে ভক্তসাধুবৃন্দ, তাঁরা কেমন করে 'নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে অরূপরাশী' -- সেই করালবদনীর ভীষণামূর্তি অবলোকন করবেন ? তাঁরা তো চক্রধারী বাসুদেবকে বংশীধারী করেছেন, গীতার ধর্মযুদ্ধকে নামসংকীর্তনে রূপান্তরিত করেছেন, স্বামীজীর বজ্রবাণীকে সলিলসমাধি দিয়ে তাঁকে অতিসুন্দর আলোকচিত্রে পরিণত করেছেন | তাঁরা তো নির্যাতিতা হিন্দু নারীর নিদারুণ ক্রন্দনধ্বনিই শুনতে পান না | তাঁদের আপনি নৈঃশব্দের বাণী শোনাতে উদ্বুদ্ধ করছেন ? আঁধারের রূপ দর্শন করাতে চাইছেন ?


ল্যাজ়ারাস্ যীশুর আহ্বানে কবর থেকে পুনরোত্থিত হয়েছিলেন কারণ মৃত অবস্থাতেও তাঁর চৈতন্যের কর্ণটি সজাগ ছিল | কিন্তু ভক্তকুল তো দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, এই সকল কর্ণই খুইয়ে বসেছেন | তাঁদের নৈঃশব্দের ধ্বনি শোনাবেন কি করে, মহারাজ ? জন্মান্ধকেও চৈতন্যের চিত্র মহাপুরুষ দেখাতে পারেন কিন্তু যাঁর চৈতন্যই লজ্জা-ঘৃণা-ভয়, এই ত্রয়ীর কৃপায় লুপ্তপ্রায়, তাঁকে কিভাবে দেখাবেন আঁধারের নিবিড় রূপ ? স্বজাতির প্রতি সমবেদনা যাঁর জাগে না, যা কিনা পশুজগতে সকল প্রাণীরই জাগে, তাঁকে কেমন করে মনুষ্যত্বের স্তরে উন্নীত করবেন মহারাজ, দেবত্ব তো 'দিল্লি দূরস্থ' ?


এঁরা রূপেসাগরে এমনিই সন্তরণরত, অরূপসাগরে যাবেন না | বৃথা প্রচেষ্টা | আর কিবা হবে এঁদের আঁধারের রূপ দেখে যখন 'বহুরূপে সম্মুখে তোমার'কে ছেড়ে এঁরা আরশিতে শুধু আত্মরূপটি দেখেই তৃপ্ত হন ও তা না হলে আবার গণমাধ্যমে দান করেন বিনামূল্যে আপন আলোকচিত্রসমূহ সর্বসাধারণের মনোরঞ্জনের জন্য ও সকলের কাছে ক্ষয়িষ্ণু আত্মমূল্যের প্রশংসারূপ মূল্যবৃদ্ধি ভিক্ষা করে ?


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)


পুনশ্চ : এই আলোচনা মানুষের মনঃপুত নাও হতে পারে সাধুর প্রতি অতিভক্তির ফলে | এটি সোমেশ্বরানন্দজীর রচনার সমালোচনা নয়, তীব্র কষাঘাত বাংলাদেশে মুসলমানকর্তৃক হিন্দুসমাজের ওপর নিদারুণ নির্যাতনের নিরিখে ভারতবর্ষে হিন্দু ভক্ত ও সাধুসমাজের আশ্চর্য নীরবতা অবলম্বনের প্রতি | আলোচনা ভিন্ন আলোকে করেছি | এতে ত্রুটি খুঁজতে চাইলে স্বাগত কিন্তু বর্তমান ব্যাখ্যার ধারা ভবিষ্যতেও চলবে জাতির প্রয়োজনে | মহারাজের বাণীর বিবিধ বিশ্লেষণ বিশেষ প্রয়োজন বর্তমান বিশ্বের বিষময় পরিস্থিতিতে |


এই রচনার কাল ও তৎকালীন বাংলাদেশের মুসলমান মৌলবাদীদের কার্যকলাপ, তার পরিমণ্ডল ও পরিপ্রেক্ষি, উৎসরূপী কার্যকারণ সম্বন্ধ, এই সকলের ইতিহাস কতটা লিপিবদ্ধ হবে ও ভাবীকালের মানুষ তা কতটা মনে রাখবেন, তা এখনই বলা দুষ্কর | বিশেষতঃ, হিন্দুদের নিজনির্যাতন নিরবে সহ্য করার দীর্ঘ অভ্যাসবশতঃ এই বিস্মরণ খুবই সম্বব ও যেহেতু বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ এ ক্ষেত্রে আততায়ীর ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের কাছেও যথাযথ ইতিহাস রচনার আশা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কিনা এই মুহূর্তে বলতে পারি না |


মহারাজের রচনার তাত্ত্বিক বিচার করছি না এবং তার যাথার্থ নিয়েও কথা বলছি না | তিনি অতি মনোরম সব রচনা রেখে গেছেন আমাদের জন্য যা অনুধ্যান করলে আমরা বিশেষ উপকৃত হবে, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ | এখানে আমি সাধুভক্তদের যে অমানবিক উদাসীনতা লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশে নিপীড়িত হিন্দুজনের প্রতি, সেই বিষয়ে আলোকপাত করতে চেয়েছি | ভক্তদের ও জনসমাজের ক্লীবতার সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য হিন্দুসমাজের জাগরণকল্পে |


মহারাজ মানুষের চোখ ফোটাতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমরা, তাঁর অনুগামীরা, শুধু তথাকথিত ভক্তিমূলক মিষ্টবাক্যের আলাপেই আমাদের ধর্মালোচনাকে সীমাবদ্ধ রেখেছি | জ্ঞানচক্ষু ফুটল কই ? শক্তিসামর্থ লাভ হল কই ? এখানেই তো ট্র্যাজেডি !


মহারাজের রচনার গূঢ় তাৎপর্য বোঝার মানুষ বিরল, তথাকথিত ফুলমালাচন্দনদাতা ভক্তই বেশী, প্রায় সকলেই | ঠিক অনুরূপ কারণেই আমার প্রতিবেদনসকলের মর্মার্থ উদ্ধারেও অসমর্থ হন অধিকাংশ মানুষ, প্রায় সকলেই | আংশিক বোঝেন, ভুল বোঝেন অথবা পড়ার প্রবৃত্তিও রাখেন না | তাই ভাবছি যে সোমেশ্বরানন্দজীর রচনার কি হাল হল, কিবা হাল কালে হবে ? তাঁর মত ক্ষুরধার বুদ্ধিযুক্ত ও স্বকীয় চিন্তাসম্পন্ন, সৃজনশীল সাধুরও তো তাহলে পরিশেষে সলিলসমাধি ! তাহলে হিন্দুর ভবিষ্যৎ কি ? ভাববার বিষয় বইকি |

No comments:

Post a Comment