Saturday 27 November 2021

সনাতন ধর্ম সহজ করে ... ২


সনাতন ধর্ম সহজ করে ... ২


হিন্দু মূর্তিপূজারি বটে কিন্তু হিন্দু মোটেও ঈশ্বরকে মূর্তি জ্ঞান করেন না | হিন্দু প্রতীককে অবলম্বন করে প্রকৃতির পারে প্রকৃত তত্ত্বে পৌঁছানোর প্রয়াস পান | স্বামীজী বলেছেন, প্রতিকৃতিকে অবশ্যই ঈশ্বর জ্ঞান করা যেতে পারে কিন্তু যে ভুলটি আমাদের এড়াতে হবে তা হল আমরা যেন কোনমতেই  ঈশ্বরকে প্রতিকৃতি জ্ঞান করে না বসি | প্রতীক অবশ্য ঈশ্বরের প্রকাশরূপে পূর্ণ ঈশ্বর কারণ ঈশ্বর অখণ্ড, তাঁর অংশ হয় না, আপাতপ্রকাশেও তিনি পূর্ণই থাকেন | কিন্তু বিশ্বপ্রকাশক ঈশ্বর তাই বলে কিছু প্রতীক নন | তিনি প্রকাশের উৎস, সত্যবস্তু, প্রকাশে অনুস্যূত অথচ বস্তুতঃ স্বতন্ত্র | ঈশ্বরের প্রতীক, প্রতীকের ঈশ্বর নয় ; প্রতীক ঈশ্বর কিন্তু ঈশ্বর প্রতীক নন |


সহজ করে বলি | আপনি যদি আপনার বন্ধুকে আপনার অনুপস্থিতা মায়ের চেহারাটি দেখাতে চান তাহলে হয়ত তাঁকে আপনার মোবাইলে তোলা মায়ের ছবি দেখাবেন | ধরুন একটি ছবিতে অনেকের সাথে আপনার মায়ের আলোকচিত্রটিও আছে | আপনার বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করলেন এঁদের মধ্যে কোনটি আপনার মা | অমনি আপনি আঙুলের ডগা দিয়ে দেখিয়ে দিলেন | বন্ধুটি বললেন, "এইটি তোমার মা ?" আপনিও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন | এর দ্বারা কি এটি প্রমাণিত হল যে আপনি মানুষ অথচ আপনার মা মানুষ নন, মানুষের আকৃতিধারিণী আলোকচিত্রমাত্র ?


এই রকমই কতকটা উত্তর দিয়েছিলেন স্বামীজী আলওয়াড়নরেশকে | মহারাজ যখন স্বামীজীর কাছে মূর্তিপূজার যাথার্থ্য ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রশ্ন তুললেন তখন যতিরাজ তরিৎগতিতে দেওয়ালে টাঙানো মহারাজের প্রতিকৃতিটি নামাতে অনুরোধ করলেন দেওয়ানজীকে | মহারাজের নির্দেশে কর্মটি সম্পাদিত হলে স্বামীজী দেওয়ানজী ও উপস্থিত সকল অমাত্যবর্গকে ঐ প্রতিকৃতির ওপর থুতু ফেলতে আদেশ দেন বজ্রবিকম্পিত কণ্ঠে | স্তম্ভিত সভাসদগণ তা মহারাজের ঘোর অপমানজ্ঞানে ঐ কর্মসম্পাদনে নিশ্চেষ্ট থাকেন ও দেওয়ানজী স্বামীজীর এই স্পর্ধার কৈফিয়ত চান | মহারাজ মঙ্গল সিংহ সকল ঘটনা যেন এযাবৎ নিরাসক্তভাবে দেখছিলেন | তাঁকে উদ্দেশ্য করে নির্ভীক যতিরাজ বলতে লাগলেন যে মহারাজের ছবি তো কাগজ ও কালিমাত্র, মহারাজ সশরীরে তো নন | তাই ছবির অবমাননায় মহারাজের ব্যক্তিসত্তার কোনও অবমাননার সম্ভাবনা আদপেই নেই | অথচ, মন্ত্রী ও অমাত্যবর্গ সকলেই মহারাজের প্রতিকৃতিতে থুতু ফেলতে অস্বীকার করলেন তাঁর ব্যক্তিত্বের অবমাননা করতে পারবেন না বলে কারণ ছবির মধ্যে তাঁরা মহারাজের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন, তাঁকে প্রায় সশরীরে মানসলোকে উপলব্ধি করছেন | ঠিক একই কারণে হিন্দু প্রতীকের পূজা করেন কারণ তিনি শ্রদ্ধাবশতঃ মানসলোকে এই প্রতীকসহায়ে তাঁর ইষ্টদেবদেবীর চিন্তা করতে সক্ষম হন | হিন্দু ভালই জানেন যে জড়বস্তু চৈতন্যময় সর্বেশ্বর না হলেও ঐ সর্বেশ্বরেরই সীমিত প্রকাশ যাকে অবলম্বন করে সাধক অসীম বিশুদ্ধচৈতন্যস্বরূপ ঈশ্বরের আরাধনা, নৈকট্য ও পরিশেষে একত্ব অনুভব করতে সক্ষম হন | মূর্তি অথবা পরিমার্জিত ও সুশোভিতভাষায় বিগ্রহ ঈশ্বরের প্রতিভূ তো বটেই কারণ তা ঈশ্বরের প্রকাশ, ঘটির জল যেমন সাগরের জলেরই সীমিত রূপ | কিন্তু তাই বলে চিন্তাশীল হিন্দু জাতি এত নির্বোধ নন যে তাঁরা ভেবে বসবেন ঈশ্বরকে মূর্তিমাত্র | 


স্তম্ভিত মহারাজ মঙ্গল সিংহের চৈতন্য হল | স্বামীজীর কাছে নিজ ধৃষ্টতার যথাযথ মার্জনা প্রার্থনা করে তিনি আধ্যাত্মিক উপদেশ ভিক্ষা করলেন | স্বামীজীও তাঁকে উপযুক্ত উপদেশ দিয়ে আশ্বস্ত করলেন |


লেখক : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment