Wednesday 3 November 2021

এ কোন্ স্রষ্টার বিচার ? এ স্রষ্টার কোন্ বিচার ?


এ কোন্ স্রষ্টার বিচার ? এ স্রষ্টার কোন্ বিচার ?

--------------------------------------------------------------


আজ ভিডিও মারফৎ এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখলাম এক আফ্রিকান রমণীর | নারীর নারকীয় নির্যাতন ও নিধন | আমার এক ফেসবুকসুহৃদের সৌজন্যে প্রাপ্ত ভিডিওটিতে এই বিভৎস প্রস্তরনিক্ষেপের দ্বারা হত্যা দেখে শিউরে উঠলাম | মন ভারাক্রান্ত, ভাবিত ও বিষণ্ণ এই নারীহননে ও আমাদের হিন্দুদের আফ্রিকা মহাদেশে ধর্মপ্রচারের বিফলতায় বিব্রত | হিন্দুধর্ম যদি আফ্রিকাবাসীর মাঝে বিপুলভাবে প্রচার করা হত ও তাঁদের সনাতনধর্মাবলম্বী করা হত, তাহলে এই সকল নারকীয় কাণ্ড হয়ত ঘটত না |


এই নারীকে কারা কি কারণে মারলেন তা জানি না কিন্তু কেমনভাবে মারলেন তা ভিডিওটিতে পরিষ্কার দেখলাম | ইংরেজিতে একে বলা হয় stoning a woman to death, অর্থাৎ, রমণীকে প্রস্তরনিক্ষেপের দ্বারা হত্যা | এ এক আদিম প্রথা | প্রস্তরযুগে এই উপায়ে পশুশিকার করা হত | বৃত্তাকারে বধ্য পশুকে ঘিরে ফেলে একসঙ্গে সবাই প্রস্তর নিক্ষেপ করত তার দিকে | এই সম্মিলিত আক্রমণে পশুটি আক্রান্ত হত ও পরিশেষে মৃত্যমুখে পতিত হত | জীবন রক্ষার্থে ক্ষুন্নিবৃত্তির অপরিহার্যতাহেতু এই আদিম প্রথার প্রবর্তন ও প্রচলন | সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার মাঝে তারই আদি ও মধ্যযুগীয় রূপান্তর রমণীর রমণাপরাধে প্রস্তরনিক্ষেপের দ্বারা নিধনের শাস্তি | কিন্তু কেন করা হয় এমন আজও একবিংশ শতাব্দীতে ও এক্ষেত্রে কি দেখলাম আমি ?


ইসলামে শাস্ত্রগতভাবে এই প্রথার সমর্থন আছে ও কট্টর মুসলমান সমাজে এর প্রচলন আছে বলে জানি | এক্ষেত্রে বুরখাপরিহিতা নারীটিকে দেখে স্পষ্টই প্রতীত হল যে উক্ত রমণী ইসলাম ধর্মাবলম্বী | মুখের রং, গড়ন ও বৈশিষ্ট দেখে আফ্রিকান বলে বোঝা গেল | শরীরের বাকি অংশ তো সম্পূর্ণ আবৃত | তাই শারীরিক বৈশিষ্ট লক্ষ্য করার কোনও উপায় নেই | তাতেই অবশ্য ধর্মপরিচয় অনায়াসে সনাক্ত করা গেল | কিন্তু কোন্ অপরাধে তাঁকে জীবন্ত অবস্থায় কবরের গহ্বরে হাতপা বেঁধে প্রবেশ করানো হল ও তাঁকে আকন্ঠ পুঁতে ফেলে ক্রমাগত চারিদিক থেকে মাথায় পাথর মেরে মেরে হত্যা করা হল ? ওঃ, কী সেই আর্তনাদ ! কয়েক মিনিট মাথায় মার খেতে খেতে স্তব্ধ হয়ে গেল সেই আকাশবিদীর্ণকারী বেদনার ক্রন্দনধ্বনি | বিশাল প্রান্তরের নৈঃশব্দের মাঝে স্পন্দহীন মস্তকটি একদিকে কাত হয়ে পড়ল | যাঁরা আততায়ী, তাঁরা নারকীয় নিধন সংঘটনান্তে প্রস্থান করলেন | বিজনপ্রান্তে পড়ে রইল নিথর নারীমুণ্ড ভূমির উপর | দেহের বাকি অংশ ভূমির নিম্নে প্রোথিত |


কোথা দয়াময় যাঁকে নারীটি হয়ত শেষ সময়ে স্মরণ করছিলেন অভিযুক্ত পাপের পরিতাপহেতু ক্ষমা প্রার্থনা করে ও পরিশেষে প্রস্তরনিক্ষেপকারীদের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য ? কি সেই পাপ ? ব্যভিচারের শাস্তি শুনেছি ইসলামী (শরিয়ত) আইনে প্রস্তরনিক্ষেপ দ্বারা মৃত্যু | তবে কি রমণী সেই অপরাধেই অভিযুক্তা হয়ে এভাবে মরণ বরণ করলেন ? এ কি ন্যায়বিচার ? এই কি দয়াময় স্রষ্টার বিধান ? মানুষ কেন এত নৃশংস ? কেন নারীর এই পরাধীনতা, এই ভয়ানক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দ্বারা নিত্যনিপীড়ন ? আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে নারীকে তাঁর ন্যায্য মানবাধিকার পেতে ? কতকাল এইভাবে অন্ধ ধর্মীয় বিধান নিয়ন্ত্রিত, নিয়মিত, নিপীড়িত করবে নারীকে ? কেন সভ্য দেশগুলি এই অসভ্য, অমানবিক মধ্যযুগীয় নির্যাতন বন্ধ করতে পারেন না নারীর ? কি লাভ তাহলে সংযুক্ত রাষ্ট্রসংঘ থেকে যদি বিশ্বের অগণিত রমণী সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকবেন এই সকল বর্বরোচিত ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে ?


যে ভিডিওটির সাপেক্ষে এই নিবন্ধটি আপনাদের কাছে উপস্থাপন করলাম তার পুঙ্খানুপুঙ্খ যাথার্থ নির্ণয় করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলে তা এখানে সংযুক্ত করলাম না | কিন্তু রচনার বৃহৎ উপাদান নির্ভুল বলে নিঃসংশয় আমি কারণ ঘটনাপ্রবাহ চোখের সামনে স্পষ্ট সংঘটিত হতে দেখলাম | অনুন্নত জাতি বলেই হয়ত এহেন বর্বর প্রথা প্রযুক্ত হল অভিযুক্তার প্রতি | এতে ইসলামধর্মের দায় যেমন অনস্বীকার্য, তেমনই সমাজসভ্যতার অনুন্নত মানও এর জন্য একইভাবে দায়ী |


প্রগতশীল শিক্ষার দ্বারা অতি শীঘ্রই এই বর্বরতার প্রতিকার সম্ভব ও তা একান্ত আবশ্যক | সংযুক্ত রাষ্ট্রসংঘের এ বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত | যে সুবিচার ধর্মের সর্বশক্তিমান পালনকর্তা দিতে পারছেন না তা রাষ্ট্রসংঘ পারবেন বলেই দৃঢ় বিশ্বাস আমার | বাকি, সময়ের অপেক্ষামাত্র | শত বিপত্তি অতিক্রম করেও মানুষের বিবর্তন রোধ করা যাবে না | আদিমকাল হতে প্রবহমান মধ্যযুগীয় ধর্মীয় কুসংস্কারের অন্ত হবেই একদিন | মাতৃকুল মুক্ত হবেন | মনুষ্যত্বের জয় হবে | সেই আশা নিয়েই নিবন্ধ শেষ করলাম নতুন উদ্যমে মাতৃকুলের মুক্তিকল্পে কাজ করব বলে | জয় মা ! সহায় হও | 


মেয়েদেরও এই মাতৃমুক্তিযজ্ঞে অংশগ্রহণ ও বলিষ্ঠ অবদান আবশ্যক, অপরিহার্য | যেখানে যেখানে মেয়েরা স্বাধীন, সেখানেই তাঁদের দিবারাত্র সোচ্চার হওয়া আশু কর্তব্য নারীমুক্তির দাবিতে | দাবানলের ন্যায় স্বাধীনতাস্পৃহার এই বহ্নিশিখা বিস্তারিত হোক | এতে যদি ইসলামধর্মের আদি বিধান ও ফলিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারা বাধা সৃষ্টি করে তো ক্রমবিবর্তিত মানুষের উন্মিষিত চেতনা তা অতিক্রম করবে, পরাভূত করবে, নারীকে পুরুষের সমমর্যাদায় মনুষ্যত্বের বেদীতে যথাযথ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবে | 


প্রণাম মাতৃকুলের নিপীড়িতা, নির্যাতিতা, নৃশংসতার শিকার প্রতিটি নারীকে কালিপূজার এই মহাশক্তির উদ্বোধনদিবসে | কালরাত্রির কালিমা দূর হোক কালীমার শুভাগমনে | সমস্ত নারীই এই মহাকালীর বিগ্রহ | প্রতিটি নারীদেহে শক্তিস্বরূপিনী মায়ের মহাশক্তি সঞ্চারিত হোক -- এই আজ ভারাক্রান্ত অথচ অনুপ্রাণিত চিত্তে কামনা করি আমার হৃদয়ে স্ফুট আজকের এই বিশ্ব নারী দিবসে | 


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment