Thursday 11 November 2021

কপটকান্নার কর্ম নয়, চাই সহমর্মিতা, শক্তিপ্রদান, বিপুল একত্ববোধ 




কপটকান্নার কর্ম নয়, চাই সহমর্মিতা, শক্তিপ্রদান, বিপুল একত্ববোধ 

---------------------------------------------------


দয়া করে পোস্টের নীচে কাঁন্নার চিহ্ন দিয়ে দুর্বলতা প্রকাশ করবেন না | তার চেয়ে হৃদয় ❤ চিহ্ন দিন, আপনার সহানুভূতির প্রকাশক হবে তা | বাংলাদেশে নিপীড়িত হিন্দুদের প্রেমচিহ্ন দিয়ে আপনার সহমর্মিতা প্রকাশ করুন | ওঁরা সত্যি সত্যি কাঁদছে | তাই আপনার কান্না গোপন রেখে আপনার সহানুভূতির শক্তি প্রদান করে ওঁদের বলীয়ান করুন | গণমাধ্যমে যথেচ্ছপ্রকাশিত কপটকান্নার দ্বারা ওঁদের বিদীর্ণ হৃদয় হতে ঝরা অশ্রুজলের অপমান করবেন না | হিন্দু অনেক কেঁদেছে | আর নয় | এবার বীরত্ব প্রকাশের সময় সমাগত |


স্বামীজী বলতেন যে বাংলার মেয়েগুলো শুধু কাঁদতেই জানে | তাই তিনি সিংহীসম মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবলকে এনেছিলেন এ দেশের মেয়েদের জাগাতে | বাঙালী পুরুষকেও পৌরুষদৃপ্ত করার জন্য স্বামীজী আজীবন চেষ্টা করে বিফল হয়েছিলেন | বেলুড় মঠে বালগঙ্গাধর তিলককে রসিকতা করে এই মহাসত্যটি বলেছিলেন যে তাঁরা যদি প্রদেশ পরিবর্তন করেন তো বেশ হয়, অর্থাৎ, বীরের দেশ মহারাষ্ট্রে স্বামীজী যাবেন বাস্তববেদান্ত প্রচার করতে ও পৌরুষবিবর্জিত বঙ্গদেশে তিলক আসবেন চরমপন্থী স্বাধীনতার বাণী প্রচার করতে |


কার্যতঃ জীবনশেষে স্বামীজী তাঁর ঘোর বিফলতার কথা বলে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন | তিনি বলেছিলেন, "দৈবদুর্বিপাকে যদি বা দেহ হল কিন্তু কোনও কাজে লাগল না | মাথাওয়ালা ছেলেগুলো সব বে করে বসেছে, নয়তো মানযশখ্যাতির বশ, নয় শরীর অপটু | আর যারা আসছে তারা উচ্চ উচ্চ ভাবগ্রহণে সমুৎসুক নয় | এই দেখে মন হতাশায় ভেঙে পড়ে | তবে, হ্যাঁ, ঠাকুরের ইচ্ছা হলে কালে এদের মধ্যে থেকেই সব মহাবীরের জন্ম হতে পারে |"


স্বামীজীর আশা আমরা পূর্ণ করতে পারিনি | ব্যক্তিগত স্বার্থের বেড়াজাল কাটিয়ে সমাজগত চেতনায়, মানবিক সহমর্মিতায় উন্নীত হতে পারিনি | শুধু কপটাচার মনুষ্যত্বের নামে, কার্যক্ষেত্রে ক্লীবতা, যে ক্লীবতা দূর করতে মোহাচ্ছন্ন মহারথীকে বাসুদেব বীরবাণী শুনিয়েছিলেন,


"ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈততত্বৈয়ুপপদ্যতে 

ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্তিষ্ঠ পরন্তপ ||"


অর্থাৎ, ক্লীবতা পরিত্যাগপূর্বক, হৃদয়ের তুচ্ছ দুর্বলতা বর্জনপূর্বক, হে পার্থ, হে শত্রুতাপন, ওঠো, শত্রুবিনাশে কৃতসংকল্প হও |


স্বদেশমন্ত্রেও স্বামীজী এই বাণীই ভাষান্তরে দিয়েছেন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে | তা পালন করলাম কি আমরা ? স্বামীজীর জীবনটাকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করলাম ? এই কি আমাদের স্বদেশপ্রেম ? এই কি স্বধর্মের প্রতি কর্তব্যপালন ? স্বামীজীকে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করলাম ? গৃহী, সাধু, সবাই কমবেশী এই কৃতঘ্ন আচরণে দোষী |


অতএব, উপায় ? ফিরে যেতে হবে ঠাকুরের কাছে | তাঁর পদতলে বসে একদিন নরেন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ হয়েছিলেন | আর আমরা কি হব না কিছুই তাঁর সান্নিধ্যে ? ভাবের ঘরের চোর আমরা | তাই পদে পদে ঠাকুরকে ঠকাই আর নিজেরা ঠকি | এ সব কপটভক্তির প্রহসন বন্ধ করে সহজ, সরল, স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাঞ্জলভাবে তাঁর প্রতিটি বাণী পালন করতে হবে যার প্রথম চরণটি হল, "লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, এ তিন থাকতে নয় |" সহজ হবে না নিজজীবনে এই অমোঘ নির্দেশ পালন করা | কিন্তু না যদি পারি তাহলে নিজেদের আর রামকৃষ্ণভক্ত বলে পরিচয় দেওয়ার অবকাশ থাকবে না | 


কথায় কথায় শাস্ত্রের শ্লোক আওড়ানো এক আর তার বাস্তব রূপায়ণ আর এক | এইখানেই ঘাটতি আমাদের | স্বামীজীর মতে শুষ্কহৃদয় আমরা, তাই এত উদাসীনতা স্বজাতির কষ্টে | কিন্তু এর প্রতিকার তো চাই | নইলে জাতি হিসেবে যে আমরা বিনষ্ট হব, বিলুপ্ত হব অচিরেই | তাই ঠাকুর-স্বামীজীর উপদেশ ও বাণীর ভ্রান্ত ব্যাখ্যা না করে তা যথাযথভাবে পালনের সময় এসে গেছে | নইলে বিধর্মীর হাতে বিনাশ অবশ্যম্ভাবী |


মনে রাখতে হবে হিন্দু যেখানেই থাক, সে ভারতবাসী | আর এই হিন্দু আখ্যা শুধু তথাকথিত হিন্দুদের জন্যই প্রযোজ্য নয়, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, ব্রাহ্ম, আর্য, দলিত, সকলের জন্য প্রযোজ্য | যে কোন সম্প্রদায় যার উৎস ভারতবর্ষে, তাই বৃহৎ হিন্দুজাতির অন্তর্গত | বিশ্ব জুড়ে এই হিন্দু সমাজ, জগৎজোড়া এই ভারতবর্ষ | এরই নাম মহাভারত | এই মহাভারতের সন্তান আমরা | এই মহাভারতের সনাতন সংস্কৃতির ধারক ও বাহক আমরা | এই বিরাট হিন্দু সমাজের প্রতিটি প্রাণী আমাদের আত্মীয়, আমাদের আপন পরিবারের সদস্য | অতএব, যে কোন হিন্দুর কষ্ট আমাদের কষ্ট, যে কোন হিন্দুর ওপর অত্যাতার আমাদের সকলের শরীরের ওপর অত্যাচার | এই একতা, এই একত্ববোধ, এই সহমর্মিতা, এই বিরাট সম্মিলিত চেতনা, এই হল হিন্দুর পুনরোত্থানের উপায়, কালপ্রবাহে ক্ষয়িষ্ণু না হয়ে বর্ধিষ্ণু হওয়ার অব্যর্থ মন্ত্র | আসুন, সমস্বরে উচ্চারণ করি সেই নব বেদধ্বনি, স্বামীপ্রদত্ত সেই অমোঘ স্বদেশমন্ত্র | হে ভারত !


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment