Wednesday 8 May 2024

সিংহশাবকই সিংহ হয়






সিংহশাবকই সিংহ হয়

☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆


আজ 'বিশ্ব সখী দিবস' | বাঙালীর প্রকৃত চরিত্রের বহির্প্রকাশের বার্ষিক পুণ্যলগ্ন | নির্বীর্য জাতির লঘু সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির পুনরাগত মাহেন্দ্রক্ষণ | সমরে অসমর্থ, বলবীর্যে ক্ষয়িষ্ণু, ইন্দ্রীয়পরায়ণতায় তৎপর, বুদ্ধিতে বক্র অথবা আপাতঃক্ষিপ্র, চৈতন্যে ফেনিল, অগভীর, ভাসমান, কি করবে বঙ্গবাসী তার আবেগের নিঃসারতা প্রদর্শন ব্যতীত এই দিনটিতে যার যথার্থ সাংস্কৃতিক তাৎপর্য তার সখীস্বভাবে পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত হওয়া অসম্ভব | এর কারণ অবশ্যই সাহিত্যস্রষ্টার কিয়ৎ পৌরুষবিবর্জিত বহু রচনা যা বাঙালীর কোমল প্রকৃতির সাথে সহজেই সাম্যস্পন্দিত | 


এই কারণেই স্বামীজী জীবদ্দশায় প্রায় মৌন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে | তিনি জাতির মধ্যে যে পৌরুষ জাগাতে চেয়েছিলেন, বাংলা ভাষাকে নতুন ছাঁচে গড়া ছিল তার অন্যতম উপায় | ভাবের বাহক ভাষা | তাই ভাষার যথাযথ সংস্কারে ভাবের পরিবর্তন সম্ভব | বাঙালীর বুদ্ধি প্রখর বটে কিন্তু ক্ষীণশরীর হওয়ায় তার জাতিগতভাবে যথার্থ পৌরুষপ্রদর্শনপূর্বক জীবনসংগ্রামে সমর্থ হওয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই কম | তাই অশনে বসনে, চলনে বলনে, হাবে ভাবে, ওঠায় বসায়, চিন্তায় চেতনায় স্বামীজী এই বাঙালী জাতিকে বিদ্যারূপ গুণে ভূষিত করে পৌরুষের সিংগমার্গে চালিত করতে চেয়েছিলেন | নিজে গদ্য রচনা করে দেখালেন কেমনভাবে শব্দে বীর্যপ্রদর্শন সম্ভব যার অজস্র সম্ভার মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্রে বিদ্যমান | উভয়েরই প্রশংসক ছিলেন স্বামীজী কিন্তু নমনীয় রবীন্দ্ররচনা সম্বন্ধে বিরক্তিতে সৌজন্যে নীরব | এর প্রমাণ পাই নিবেদিতার চিঠিতে ও ওকাকুরার সাথে স্বামীজীর বেলুড় মঠে বাক্যালাপে |


তাহলে কি বলতে চাইছি যে রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্পূর্ণ পৌরুষবিবর্জিত ? কখনই নয় | কিন্তু তাঁর রচনার শৈলী, রচনার ধারা, রচনার বিষয়বস্তু, ভাব, গতিপ্রকৃতি মূলতঃ কোমল ও অনেকাংশেই দুর্বল ও অবিদ্যাশ্রিত যা জাতিগঠনের পরিপন্থি | তার বিষবৎ ফল আজকের বঙ্গসমাজে কিয়ৎ প্রমাণিত | অবশ্য বাঙালী স্বভাবতঃ এইরূপ ইন্দ্রিয়পরবশ বলেই রবীন্দ্রনাথের দুর্বল দিকটি আরও দুর্বলভাবে গ্রহণ ও প্রসার করেছে | কিন্তু সাহিত্যিকের দায় এড়াবার যো নেই এভাবে | তিনি ভাবের অমৃত ছড়ান, ভাল কথা | কিন্তু ভাবের বিষ সংক্রমণ করবেন সমাজের বুকে সাহিত্যসৃষ্টির অধিকারে, তাহলে কালক্রমে তার প্রতিরোধ ও সমালোচনারও সম্মুখীন হতে হবে | স্বামীজীর আপত্তি কোথায় তা বুঝতে গেলে বীরাঙ্গনার গর্ভে জন্মাতে হবে | একদিকে বীরত্ব, অপরদিকে বৈরাগ্য, এই দুই গুণের যথোচিত সমন্বয় না হলে বোঝা যাবে না স্বামীজীর পৌরুষের আহ্বান ও সকল অবিদ্যাশ্রিত সখীভাব সাময়িককালের জন্য বর্জনের আদেশ জাতিগঠনের উদ্দেশ্যে |


স্বামীজীকে গ্রহণ করেছিলেন বাংলার বীর বিপ্লবীরা, বর্জন করেছে ভীরু বাঙালী | শুধু 'জয়তু স্বামীজী' ধ্বনিতে ও কপট ভক্তিপ্রদর্শনে মহাদেবের কৃপালাভ হবে না | তাঁর বাণী ধমনীতে প্রবাহিত হলে জাগবে বলবীর্য যা তাঁর অনুগামী সন্ন্যাসীদের মধ্যেও প্রায়শঃই পরিলক্ষিত নয় | স্বামীজী নিত্য বারবেল করার আজ্ঞা দিয়েছিলেন বেলুড় মঠে | লাটু মহারাজ আপত্তি করেন | স্বামীজী তাই তাঁকে এই দায় হতে মুক্ত করেছিলেন কিন্তু বাকি সকলের ওপর এই আদেশ ধার্য ছিল | তিনি দূর্গাপূজার আয়োজন করেন বেলুড় মঠে এবং মহাষ্টমীর দিন পাঁঠা বলি দিতে উদ্যত হন | শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী সূচনাতেই পশুবলি বন্ধ করেন এই বার্তা দিয়ে যে সন্ন্যাসী সর্বজীবের কাছে অভয়ের প্রতীক | স্বামীজী মেনে নেন কিন্তু তাঁর আদি উদ্দেশ্য ছিল বাংলার যুবকদের সশস্ত্র বিপ্লবে উদ্বোধিত করা | বাংলার ছেলেরা মেয়েরা সেদিন সেই ডাকে সারা দিয়েছিলেন | বোমা, বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন হাতে | বৃটিশ ভয়ে প্রকম্পিত হয় | তিলককে ১৯০১ সালে বেলুড় মঠের প্রাঙ্গনে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ বলে উঠলেন স্বামীজী, "What India needs today is a bomb." ("ভারত এখন যা চায় তা হল একটি বোমা |") দেড় বছরের মধ্যে স্বামীজীর দেহ চলে গেল | তারপরই বাংলায় হল অগ্নিযুগের বিস্ফোরণ !


রচনা: সুগত বসু (Sugata Bose)


পুনশ্চ: আজ শুধু সাধারণ বাঙালীই স্বামীজীকে ভক্তিতে অভক্তিতে বর্জন করেছে এমন নয় | তাঁর সন্ন্যাসী অনুগামীরাও তাঁর প্রদর্শিত পৌরুষমার্গ ত্যাগ করে রবীন্দ্রমার্গ গ্রহণ করেছেন | দুর্বল নৃত্যগীতের যে প্রদর্শন মাঝে মাঝে দেখি বেলুড় মঠে, সেই ভঙ্গিমা ছিল স্বামীজীর অনভিপ্রেত | সখীসুলভ আচরণ স্বামীজী পুরুষমানুষে অপছন্দ করতেন ও সারাজীবন নানাভাবে শুধু পৌরুষপ্রদর্শনের ওপরই জোর দিয়েছেন | বেদান্ত প্রচার করেছেন ইয়োরোপ ও আমেরিকায়  কিন্তু কি বলিষ্ঠ ভাব ! আজ সেই বেদান্তই সম্পূর্ণ সখীসুলভভাবে আমেরিকায় প্রচার করছেন তাঁরই উত্তরসূরী যা বাঙালী তথা গোটা ভারতে সমাদৃত | অথচ স্বামীজীর ভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত এই সখীসুলভ বেদান্তপ্রচার | তবে তা সর্বসাধারণ নিচ্ছে কেন ? ঠিক ওই কারণে যে কারণে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মেয়েলী মাতামাতি বাঙালীর মধ্যে | গোটা জাতিটা মেয়েমানুষে পরিণত হয়েছে | এ বিষয়ে স্বামীজীর কথা ধর্তব্য---"চৈতন্যদেব ঊড়িষ্যা আর বাংলাটাকে মেয়েমানুষের জাতে পরিণত করেছেন |"


বজ্রনির্ঘোষে বেদান্ত ধ্বনিত হ'ক, সিংহগর্জনে নিনাদিত হ'ক দিকে দিকে | মহাদেবের ত্রিশূল হতে উৎক্ষিপ্ত হ'ক ত্রিদিশায় বেদান্তভাবত্রয় | স্বামীজীর আদর্শ পরিপূর্ণতা লাভ করুক নবপ্রজন্মের সিংহশাবকের মাঝে | তিনি মঠের সন্ন্যাসী ভাইদের বলেছিলেন, "আমি শুধু আগমনি গেয়ে গেলাম | আজ থেকে পাঁচ ছয় প্রজন্ম পর তারা আসবে বহুদূর হতে যারা এইসব মনিরত্ন যা রেখে গেলাম তা নিয়ে খেলা করতে | তোরা এগুলো যত্ন করে রাখিস |" 


সেদিন বলিদান বন্ধ হয়েছিল মায়ের আজ্ঞায় | আজ কার আজ্ঞায় ঠাকুর-স্বামীজীর আদর্শ নিত্যবলি হচ্ছে ?

No comments:

Post a Comment