আজ গুরুপূর্ণিমা ... ১

8
আজ গুরুপূর্ণিমা ... ১
♡♡♡♡♡♡♡♡♡♡♡♡♡
কি উপনিষদ ? কিসের উপনিষদ ? যারা আজকের ঋষিদের চিনতে পারল না, তারা পুরাকালের ঋষিদের চিনবে ? তাও কি হয় ? তা কি কস্মিনকালেও হয়েছে ? তোমার সামনে ঋষি, তুমি চেনো না | তুমি নিজে ঋষি, তুমি জানো না | পুঁথিপাতরায় খুঁজছ ঋষিবাক্য, হে আহাম্মক, ঋষি তোমার অন্তরে ! আত্মশ্রদ্ধা করতে শেখো, তবে তো হবে | নিজের মাকে মানো না, বিশ্বমাকে পাবে ? নিজের দেশকে ভালবাসো না, মানবপ্রেমী (humanist) হবে ? আরে, রবি ঠাকুর কি লিখলেন বালক সত্যজিতের খাতায় ?
'বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে,
বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে,
দেখিতে গিয়াছি পর্বত মালা,
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু |
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু |'
ঠাকুর বলছেন, "ঈশ্বর বড়লোক, তাই লোকে মানে তাঁকে | ঈশ্বর গরিব হলে কে মানত ?"
মা বলছেন, "এখন সব ভক্তরা ঠাকুরকে ভাল ভাল মিস্টি ভোগ দেয় | জানে কিনা, নিজেরাই খাবে |"
বরাহনগর মঠে এককালে খেতে পেতেন না স্বামীজীরা | যেদিন জুটত বিয়েবাড়ীর খাবার, সেদিন বরাদ্দ হত তেলাকুচোপাতাসেদ্ধ | যেদিন রেস্তোরাঁর খাবার কপালে থাকত, সেদিন জুটত নুনভাত, নইলে শুধু ভাত | আর যেদিন অন্নসত্রের খাবার ভাগ্যে থাকত, সেদিন নিরাহারে জপধ্যান | আর আজ ? প্রসাদী কুপন অর্থের বিনিময়ে ! বাবুরাম মহারাজ কাঁদছেন | নিজেরা না খেয়ে খাওতেন কিনা |
এই অস্তিত্বই ব্রহ্ম | ভগবান পাব কোথায় ? এখানে, এখনই | পেয়েই বসে আছি, তবু পাওয়া চাই | নইলে যে মায়ে বাঁধে, মায়ায় বাঁধে | মায়ে বাঁধুক, মায়ায় না বাঁধুক | তাঁর নামে মুক্তি | আলবৎ হবে !
ঠাকুরের নাম করে বটে কিন্তু তাঁর কথা কেউ মানে না | তাই তো তাঁর পুনরাগমনের পূর্বপ্রতিশ্রুতি | "বায়ুকোণে আর একবার দেহ হবে | ... যারা অন্তরঙ্গ, তাদের মুক্তি হবে না | ... পার্ষদদের কাউকে পূর্ণজ্ঞান দিলাম না | তা দিলে, তারা আবার আসবে কেন ?"
স্বামীজী বললেন, "রোজ লক্ষ কপি 'উদ্বোধন' পত্রিকা বিনামূল্যে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় বিলি করা যাবে যদি অর্থে কুলোয় |" যুবা বয়সে ভাবতাম, "স্বামীজীর এই ব্রহ্মসংকল্প কই সার্থক হল না তো ?" প্রৌঢ়ত্বে এসে ইন্টারনেটযোগে শেষে যখন সম্ভব হল এই মহদেচ্ছা পূর্ণ হওয়ার, এমনকি রামকৃষ্ণ মিশনের 'Online Reading Room' চালু হল যাতে ঠাকুরের মূল গ্রন্থগুলি বিনামূল্যে পাঠের সুযোগ হল, তখন ভাবলাম, "যাক, এতদিনে এ বিষয়ে স্বামীজীর ঋষিবাক্য সিদ্ধ হতে চলল |" কিন্তু আজও 'উদ্বোধন' লক্ষ কপি প্রত্যহ বিনামূল্যে ইন্টারনেটযোগে বিলি করা সম্ভব হয়নি | প্রতীক্ষায় আছি | আজ প্রযুক্তির সাহায্যে লক্ষ কেন, কোটি কপি মুহূর্তে ছড়িয়ে দেওয়া যায় বিশ্বজুড়ে | ঠাকুরের কৃপায় তাই হ'ক | ভেসে যাক জগত রামকৃষ্ণপ্রবাহে ! কিন্তু ভুললে চলবে না 'টাকা মাটি, মাটি টাকা |' এটি যে ভুলে গেছেন তাঁর অনুগামীরা প্রয়োজনের অছিলায়, অর্থনীতির অনুজ্ঞায় |
আজ গুরুপূর্ণিমা | পিতৃদিবস, মাতৃদিবস, প্রেমদিবস, আরও কত কি নিত্যনতুন দিবসে বর্ষ পূর্ণ | এরই মাঝে সেই সনাতন দিবস, গুরুপূর্ণিমা, নিজস্থানটি বজায় রেখেছেন | এটি গুরুর কৃপা নয় ? কৃপা বইকি |
গুরু সম্বন্ধে ঠাকুরের কতরকম কথা |
১) সচ্চিদানন্দ গুরু |
২) ঈশ্বর গুরুরূপে অবতীর্ণ হন |
৩) গুরুর মধ্যে মানুষবুদ্ধি করলে ছাই হবে | গুরুর মধ্যে ঈশ্বরবুদ্ধি করলেই হবে |
৪) কাঁচা গুরু ওই ঢোঁরা সাপের ন্যায় | ব্যাংটাকে ধরেছে | এখন না পারে গিলতে, না পারে ফেলতে | এতে সাপেরও কষ্ট, ব্যাঙেরও কষ্ট | জাত সাপ হলে তিন ডাকেই সাবাড় |
৫) যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ী যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায় |
৬) হেগো গুরু, তার পেদো শিষ্য |
স্বামীজী স্বভাবসিদ্ধভাবে প্রবাদবাক্য উলটে দিয়ে বলছেন, "চেলা মিলে লাখে লাখ, গুরু না মিলে এক |"
স্বামীজী বলেছিলেন, "Religions of the world have become lifeless mockeries. What the world wants is character." এই চরিত্রের অভাবেই সমাজে, জীবনে যত গোল |
মশাই, উপনিষদ পড়লে, পড়ালে, প্রচার করলে কি হবে ? চরিত্র কই ? সবই তো ওই টাকার দাস | বাবার মুখে ছোটবেলায় শুনেছি---'জগতটা কার দাস ? জগত টাকার দাস |' Associative law of words. বুঝেছেন ? না বুঝলে ক্ষতি নেই | বুঝলেই গোল | না, না, ফুটবলের নয়, বেদান্তেরও নয়, গণ্ডগোলের গোল |
এখন উপায় কি ? চরিত্র তৈরি হবে কি করে ? ভূপতিত আদর্শে জীবন দাঁড়াবে কিভাবে ? ওই যে---ভাবে | এখনও মরে যায়নি ভাব, সঞ্চিত আছে বাণীরূপে, তৎসহায়ে স্মৃতিরূপে, চরিতামৃতে, কথামৃতে, স্বামীজীর বাণী ও রচনায় | এঁরা সব শুধু শাস্ত্র নন, এঁরা সাধু | মহাপুরুষ মহারাজের শিষ্য স্বামী নারায়ণানন্দ তো তাই বললেন কথামৃত সম্বন্ধে | সম্ভবতঃ ১৯৮৪ সালে বলেছিলেন আমায় বেলুড় মঠে |
'অদ্যাবধি লীলা করেন গৌর রায়,
কোনো কোনো ভাগ্যবান দেখিবারে পায় |'
"ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস ? আয় | আমি যে আর থাকতে পারি না |" ঠাকুরের এই ডাক আজও শোনে মানুষ | আজও দক্ষিণেশ্বরে হাতে লন্ঠন নিয়ে গভীর রাতে মন্দিরপ্রাঙ্গনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন ঠাকুর কখন বুঝি ওই নরেন, রাখাল ফিরবে, কখন তারা তাঁর আকুল ক্রন্দনে সাড়া দিয়ে ছুটে আসবে শিশু যেমন মাতৃক্রোড়ে ছুটে আসে খেলাশেষে |
কিন্তু এখানে তো খেলা শেষ নয় | এখানে তো সবে লীলা শুরু | এ অবতারলীলা | এ শুধু নরেনের, রাখালের, বাবুরামের, লাটুর লীলা নয়, এ আপনার, আমার লীলা, আমাদের সকলের লীলা | তাই এর ব্যাপ্তি বহুপ্রসারিত, অবতারলীলা থেকে জগতলীলা |
আসুন, ঠাকুরের ডাকে সাড়া দিই | চলুন সেই পূর্বপরিচিত ঘরে যেখানে এই সদ্য ঠাকুর সমাধিভঙ্গে আবার কথা বলতে শুরু করেছেন | ওই ঠাকুর আবার সমাধিস্থ ! ঘর নিশ্চুপ | নৈঃশব্দের আনন্দধ্বনিতে মুখরিত সকল অন্তর | আমরাও এক কোণে বসে পান করছি সেই অমৃতসুধা, দেখছি এই অপূর্ব মানুষটিকে | 🕉
রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)
No comments:
Post a Comment