Tuesday, 22 July 2025

উত্তিষ্ঠত ! জাগ্রত ! ... ৯ (ঊষাপ্রকাশ, ২৩ জুলাই, ২০২৫)



উত্তিষ্ঠত ! জাগ্রত ! ... ৯

(ঊষাপ্রকাশ, ২৩ জুলাই, ২০২৫)

♤♤♤♤♤♤♤♤♤♤♤♤♤♤♤♤♤♤


সম্পাদকীয়

♤♤♤♤♤♤♤


যখন টাকা ছিল না, তখন সাধু ছিল | আজ টাকা হয়েছে, এখন সাধু কই ? বিধাতা ও তাঁর বিখ্যাত বাণী আজ ব্রাত্য | 'টাকা মাটি, মাটি টাকা' যা সন্ন্যাসরক্ষায় সবচেয়ে বড় ঢাল, যা স্বয়ং শ্রীমুখনিঃসৃত, আজ তা বর্জিত, সঙ্ঘচালনায় শুধু নিষ্প্রয়োজন নয়, অন্তরায়স্বরূপ বলে বিবেচিত, বৈশ্যযুগের এমনই অবক্ষয় | 


কয়েক দশক আগে (১৯৮০র দশকের মাঝামাঝি) রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে সহকারী সম্পাদকরূপে কর্মরত বিভূতি মহারাজকে (স্বামী তত্ত্বস্থানন্দকে) বলেছিলাম, "মহারাজ, আপনাদের অর্থাভাবে বড়ই কষ্ট | একটা অফিস ঘর পর্যন্ত ভালমত নেই | ঠাকুর একটু স্বচ্ছলতা দিলে পারেন না যাতে কাজের একটু সুবিধা হয় ?" তৎক্ষণাৎ আমাদের সদা স্মিতহাস্যময় বিভূতি মহারাজ বলে উঠলেন, "ও অভিশাপ দিয়ো না | সাধুর পক্ষে এই অভাবই ভাল | যে মুহূর্তে টাকা হবে, সাধু আর সাধু থাকবে না |" কথাটার তাৎপর্য, গূঢ়ার্থ, গত চার দশক ধরে ধীরে ধীরে বুঝেছি---এখন তার অর্থ জলের মত পরিষ্কার |


গতকাল স্তম্ভিত হলাম ইউ টিউবে উদ্বোধন কার্যালয়ের 'উদ্বোধন-বান্ধব' অর্থাগম প্রকল্প দেখে | মাসিক ন্যূনতম ৮৯ টাকা চাঁদা দিলে উদ্বোধনের কিছু বাছাই করা ভিডিও (Members-only videos) দেখতে পাওয়া যাবে | 'ন্যূনতম' কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ তার নীচে অর্থ দিলে ভক্তের ওই চ্যানেলে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ কিন্তু তার ঊর্ধ্বে যত দাও, তত ভাল | নানা মূল্যের নানা বান্ধবপ্রীতি প্রকল্প আছে | কোন বাধা নেই সে অতিদানে | বেলুড় মঠে প্রসাদের কুপনের ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যবস্থা, সেই একই অভিজ্ঞতা | এখানে তো তবু মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে কিন্তু মূল মঠে তো প্রসাদের কুপনের ন্যূততম মূল্য অনুল্লেখিত | ন্যূনতম মূল্যটি না দিলে প্রসন্নতা হতে বঞ্চিত হতে হবে | ("প্রসাদ হল যা চিত্তকে প্রসন্ন করে," বলেছিলেন আমায় রনেন মহারাজ ২০১২ সালে |) আর, কত সেই ন্যূনতম মূল্য যাকে দান বলে চালানো হয় কিন্তু যা দান নয়, প্রসাদ পাওয়ার জন্য ধার্য দাম, তা কিন্তু উহ্য রাখা হয়েছে | যদি তার চেয়ে কম দেওয়া হয়, তো অর্থ ফেরত, প্রসাদ পাওয়া যাবে না | আর যদি তার চেয়ে বেশী, এমনকি ঢের বেশী কেউ দেন, তো তা অম্লানবদনে নেওয়া হবে | ভিন্ন ক্ষেত্র হতে একটা উদাহরণ দিই বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য | মনে করুন, চলচ্চিত্রের একটি টিকিটের দাম ২০০ টাকা | আপনি কাউন্টারে ১৯০ টাকা দিলেন | পুরো টাকা ফেরত এল এই বার্তা সমেত যে আপনি ১০ টাকা কম দিয়েছেন, টিকিট দেওয়া যাবে না | এবার আপনি ৫০০ টাকার একটা নোট দিলেন | কাউন্টারে যিনি আছেন, তিনি আপনাকে একটা টিকিট দিয়ে দিলেন কিন্তু বাকি ৩০০ টাকা অম্লানবদনে রেখে দিলেন, ফেরত দিলেন না | এ বেশ ব্যবসা ! এর নাম দেওয়া যাক 'মূল্যদানের পালা' | এখানে প্রণিধানযোগ্য এই যে ন্যূনতম মূল্যমান অঘোষিতভাবে ধার্য হলেও ঊর্ধ্বতন মূল্যমানের কোন সীমা নেই | এইটি তাৎপর্যপূর্ণ | এই নয় যে balance amount ফেরত না দিয়ে কর্মচারী দান ভেবে রেখে দিলেন | আপনি যা নিজে থেকে দিলেন সেই অনুযায়ী অতিরিক্ত টাকা ফেরত পেলেন | এখানে কোন গোলমাল নেই | গোলমাল পুরো অস্বচ্ছ কুপনমূল্য ব্যবস্থায় | 


বহুকাল 'টাকা মাটি, মাটি টাকা'---এই যুগবাক্য শুনতে পাই না | এখন তার উল্টোটা কিনা---'টাকা খাঁটি, খাঁটি টাকা' ? এ কথা তুললেই 'জ্ঞানদা-মাস্টার' ও 'ভক্তিপ্রদা-দিদিমনি' আমায় শ্রীশ্রীমায়ের একটি উক্তি শুনিয়ে চুপ করিয়ে দেবেন, স্বামীজীর উক্তি দিয়ে আমায় স্তব্ধ করবেন | কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে | এত সব করেও কি বিবেককে চুপ করাতে পারবেন ? কি জবাব দেবেন ঠাকুরকে ? এই, যে "আপনি মশাই মস্ত বড় গোল করে গেছেন সব অতিরিক্ত ত্যাগের কথা বলে | আমাদের কি রিক্ত করার ব্যবস্থা করেন নি ?" উত্তরে ঠাকুর কি বলবেন সে তিনিই জানেন | তবে তাঁর যুগভাবের, যুগবাণীর ও যুগাদেশের বিপরীতগামী হওয়ারও তো সীমা আছে | তাই তাঁর পুনরাগমনের পুণ্যলগ্ন আসন্ন | ২০৩৬এ তাঁর ১৮৩৬এর আবির্ভাবের ২০০ বছর অতিক্রান্ত হবে | স্বামী সারদানন্দ 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ'-এ লিখেছেন যে তিনি নির্ভরযোগ্য সূত্রে শুনেছেন যে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন যে তিনি ২০০ বছর বাদে আবার আসবেন | এখন এই পূর্ণ অবক্ষয়ের কালে সেই পূর্ণ আবির্ভাবের অপেক্ষা | 


ঠাকুর-স্বামীজী কর্তৃক সত্যভাষণে আদিষ্ট,

ঠাকুর-মা-স্বামীজী-গুরুদেবের চরণাশ্রিত,

সঙ্ঘের সত্য হিতাকাঙ্ক্ষী,

সঙ্ঘকল্যাণে নিত্যব্রতী প্রার্থনারত,

সুগত বসু (Sugata Bose)


🕉 সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ! 🕉 


পুনশ্চ : 

♤♤♤♤


১) 'টাকা হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না---আকৃতিটা মানুষের, স্বভাব পশুর |' -- শ্রীরামকৃষ্ণ 


২) 'টাকা মাটি, মাটি টাকা |' -- শ্রীরামকৃষ্ণ 


৩) 'The bane of every spiritual organisation is when it hangs by the sleeves of the rich.' -- Swami Vivekananda 


বিবেচনার বিষয় : 

♤♤♤♤♤♤♤♤♤♤


ভক্তদের যদি ইউ টিউব চ্যানেলের বিশেষাংশে মাসিক অনুদান না দিলে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হয়, তাহলে প্রচারকার্য তো সেই অনুপাতে ব্যাহত হল | তার কি ? স্বামীজী যে বলেছিলেন ভবিষ্যতে অর্থাগম হলে 'উদ্বোধন' পত্রিকাটি কলকাতার পথে পথে দৈনিক লক্ষ কপি বিনামূল্যে বিলি করতে ? আর আজ সেই 'উদ্বোধন কার্যালয়ের' ইউ টিউব চ্যানেলেও টাকা দিতে হবে ? নইলে, "ফিরে যাও | তোমাদের জন্যে ঠাকুর-মা-স্বামীজীর বিশেষ বার্তা নয় | ওটি মূল্যে ধরে দেওয়া হয়, মূল্য দিয়ে নিতে হয় |" অবতার কি বাণিজ্য করতে আসেন মর্ত্যে নাকি তাঁর অনুগামীদের সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে এই ব্যবহার করতে শিক্ষা দেন ? এ সব কথা গভীর মর্মবেদনায় বলছি, সাধের সঙ্ঘের সর্বত্র এই ব্যবহারিক উন্নয়ন আত্মিক অবনমনের পরিবর্তে দেখে (material welfare at the expense of spiritual values) | এতে শতবর্ষ ধরে অর্জিত goodwill নষ্ট হচ্ছে, জনসমক্ষে সঙ্ঘের ভাবমূর্তি নেমে যাচ্ছে, শতবর্ষ ধরে কত তপস্বী, যোগী, মহাপুরুষের ত্যাগের ফল অনর্থক অনর্থকারী অর্থে রূপায়িত হয়ে দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে, সঙ্ঘের আদর্শ খর্ব হয়ে নবপ্রজন্মের সাধু-ব্রহ্মচারীদের বৈরাগ্যবিমুখ, বিষয়াসক্ত, আদর্শচ্যূত, বিভ্রান্তচিত্ত হতে প্ররোচিত করছে এবং বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের উচ্চ আত্মা সকলকে মঠে যোগদান করা হতে বিরত করবে | এগুলো ভাববার বিষয়, নইলে পার্থিব সমস্যা মেটাতে গিয়ে আরও গভীরতর পার্থিব সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে হবে, অবিদ্যামায়ার এমনই খেলা | সাধুর চরিত্রগঠন হবে কি করে ? কোন্ মুখেই বা বৈরাগ্যভাষণ দেবেন সাধু যখন অন্তরে জানেন যে তাঁরা নিজেরাই প্রদত্ত উপদেশ পালন করেন না সঙ্ঘগতভাবে ? এটি চিন্তার বিষয় নয় ? ঘোরতর দুশ্চিন্তার বিষয় | ঠাকুরের সেই নিত্যগোপালকে বলা, "সাধু, সাবধান !" মনে পড়ছে | আমরা মঠের অনুগামী আজীবন | জীবনসায়াহ্নে এসে কি তবে এই দেখতে হবে যে আমরা মঠমিশনের থেকে অর্থকড়ির বিষয়ে ঢের বেশী ত্যাগী ? এরূপ হোক, তা তো কোনদিনও চাইনি |

No comments:

Post a Comment