Thursday, 10 July 2025

আজ গুরুপূর্ণিমা ... ২








আজ গুরুপূর্ণিমা ... ২

♡♡♡♡♡♡♡♡♡♡♡♡♡


গুরু দীক্ষা দেন করুণাপরবশ হয়ে | নইলে কি দায় তাঁর ? তিনি তো মুক্তপুরুষ | কেন নেন তাহলে শিষ্যোদ্ধারে তাঁদের পাপসকল নিজদেহে যা তাঁকে পরিশেষে দেহাবসানের দিকে ঠেলে দেয় ? কেন নিলেন বীরেশ্বরানন্দজী ৮০,০০০ শিষ্যের ভার, ভূতেশানন্দজী ১২০,০০০ শিষ্যের দায়িত্ব, রঙ্গনাথানন্দজী ৬০,০০০ শিষ্যকে ওই প্রশস্ত স্কন্ধে, আত্মস্থানন্দজী কেন বা নিলেন ১১০,০০০ জনের গুরুভার আর কেনই বা গহনানন্দজী নিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যক শিষ্যের ভার---১৪২,২৪১ জন ? কেন নেন পাপের ভার ? কেন সুস্থ দেহকে অসুস্থ করেন এভাবে শিষ্যসমূহের পাপরাশি গ্রহণ করে দধীচী মুনির ন্যায় আত্মত্যাগ করে, যেন সেই পুরাকালের বজ্রনির্মাণ নিজ অস্থি বজ্রবস্তুতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য দান করে ? কি পান এই আত্মত্যাগে এই মহান মানুষগুলি যাঁদের মনুষ্যত্ব ঊর্ধ্বমূর্ত হয়েছে দেবত্বপ্রাপ্তিতে ? 


এর উত্তর একটাই---একত্ববোধ হতে প্রবাহিত প্রেম, নিষ্কলঙ্ক, নির্মোহ, অপার্থিব, বিশুদ্ধ প্রেম | 


গুরু যিনি হন, তিনি ঈশ্বরের কৃপায় পূর্বেই সমাধিবান হয়ে থাকেন | আত্মদর্শনে পূর্ণকলস তখন বুত্থানে সেই অতিন্দ্রিয় জগতের বার্তা নিয়ে ফেরেন যার প্রবাহের নাম প্রেম | হৃদয়ের উৎসস্থলে যে রসরাজের সন্ধান এই জীবনমুক্ত মহাপুরুষেরা পান, তাঁরই সাথে আলাপ করিয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা জেগে ওঠে তাঁদের হৃদয়ে | এই ঐশী আস্পৃহার নাম কৃপা | ত্রিতাপে দগ্ধ মানুষের অজ্ঞানপ্রসূত দুঃখদুর্দশা দেখে এঁরা আর স্থির থাকতে পারেন না | পূর্বের বদ্ধতার স্বীয়স্মৃতি বোধ হয় তাঁদের উদ্বেলিত করে তোলে মানবমুক্তির ব্রতপালনে তৎপর হতে | এর নাম সাম্যস্পন্দন---স্মৃতিতে, বাস্তবে | 


জীবনমুক্ত মানুষ তো কুকর্ম করতে পারেন না, শুধু সুকর্মেই তাঁর আগ্রহ, অনুপ্রেরণা | তিনি মুক্ত কিন্তু তাঁর সর্বকর্ম সমাধির পূর্বে ব্যয়িত হয়ে শূণ্য হয়নি এখনও, তাই তাঁকে কিছু কর্ম করতে হয় | দীক্ষাদান সেই কর্ম | শিষ্যের পাপগ্রহণ আর নিজপুণ্যফল তাঁকে দান, এই প্রক্রিয়ায় গুরুর জমা কর্ম ক্ষয় হয় দ্রুত এবং তিনি বিদেহমুক্তির পথে অগ্রসর হন সত্বর | অবশ্য ঈশ্বরীয় প্রেমের এই সরলীকরণ ও মোটা দানায় কার্যকারণ সম্বন্ধ স্থাপনের প্রয়াস বৌদ্ধিক শৃঙ্খলা স্থাপনের নামান্তর হলেও পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা বলে বোধ হয় না | শ্রীগুরু ঈশ্বরীয় কোন্ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে শিষ্যোদ্ধারে আত্মত্যাগ করেন, তা বলা ভার | জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে ত্যাগ প্রতিষ্ঠিত যার ফলে বিবর্তন, অগ্রগতি, সীমা হতে অসীমের পথে গমন | এই হল প্রকৃতির নিবৃত্তিমার্গে নিয়ম | প্রেমের কার্যকারণ সম্বন্ধ এই বিশ্বায়নের মধ্যে | তার সার্থকতাও সেখানে | কিন্তু প্রেম সম্বন্ধে সর্বশেষ কথা বলা ধৃষ্টতা কারণ তার একটি অনির্বচনীয় নিয়মবহির্ভূত দিক আছে যা তাকে সৃষ্টিশীল করে রেখেছে কাব্যে, সংগীতে, সাহিত্যে, চিত্রশিল্পে, কৃষ্টির আরও কত ভূমিকায় | তাই ভগবান নির্বাসনা হয়েও জীবকে কেন ভালবাসেন, এ কথা নির্ণয় করার প্রয়াস নিরর্থক না হলেও শতভাগ নিরূপণ করা প্রায় অসম্ভব | তাই কৃপার কল্পনা যা কিনা নিয়মবহির্ভূত | সদগুরুসকল তাই নিয়মের মধ্যে পড়েন না | অবশ্য বাণিজ্যিক 'সদগুরু'রা তো প্রতারক, তাঁরা পড়েন নিয়মের মধ্যে এবং নিয়মানুযায়ী নিম্নমার্গে ক্রমশঃ পতিত হন |


বেলুড় মঠের ইতিহাস গুরুমহিমায় গৌরবোজ্জ্বল | ঠাকুর আদি গুরু | এরপর মা, স্বামীজী ও রাজা মহারাজ | তারপর মহাপুরুষ মহারাজ, শরৎ মহারাজ, কালী মহারাজ, গঙ্গাধর মহারাজ, বিজ্ঞান মহারাজ ও তুলসী মহারাজ | এঁরা সব পূর্ণাবতার কিম্বা অংশাবতার, এক একজন আধ্যাত্মিক মহীরূহ | রামকৃষ্ণ সংঘের গুরু পরম্পরা এঁদের শ্রীচরণ ধরেই সূচিত, প্রবাহিত | 


এই গেল ঠাকুরের বাউলের দলের গুরুপদ বরণ | এরপর স্বামী শুদ্ধানন্দ, বিরজানন্দ, শংকরানন্দ, বিশুদ্ধানন্দ, মাধবানন্দ, বীরেশ্বরানন্দ, গম্ভীরানন্দ, ভূতেশানন্দ, রঙ্গনাথানন্দ, গহনানন্দ ও আত্মস্থানন্দ | স্বামী ব্রহ্মানন্দ হতে শুরু করে এই ১৫ জন সংঘাধ্যক্ষ আধ্যাত্মিক মহিমায় অত্যুঙ্গে অবস্থিত | 


এর পর স্বামী স্মরণানন্দ ও স্বামী গৌতমানন্দ | এঁরা কিন্তু পূর্বের পনেরো জনের তুলনায় কিয়ৎ ম্রিয়মান | কালপ্রবাহে আদর্শের ক্ষয় হয়েছে বিগত কিছু বর্ষ এবং তার প্রতিফলন বুদ্ধিমানের দৃষ্টিতে সহজেই ধরা পড়ছে আজ | তবুও দীক্ষা নিরবচ্ছিন্ন চলেছে | ঠাকুরের কৃপাবারি আজও বর্ষিত হচ্ছে ষঢ়গুরুর মাধ্যমে---যথা, গৌতমানন্দ, সুহিতানন্দ, ভজনানন্দ, গিরিশানন্দ, দিব্যানন্দ ও বিমলাত্মানন্দ চিত্ত হতে | দিকে দিকে প্রবাহিত হচ্ছে রামকৃষ্ণ ভাবগঙ্গা | 


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment