Saturday, 1 April 2023

অস্তাচলে সূর্য, এ এক নব সূর্যোদয়


অস্তাচলে সূর্য, এ এক নব সূর্যোদয় 

-----------------------------------


রামকৃষ্ণলোকে বরুণ মহারাজ (স্বামী প্রভানন্দ) | স্বামী শংকরানন্দশিষ্য, অগণিত ভক্তের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক, বিদগ্ধ পণ্ডিত, প্রবীণ সন্ন্যাসী আজ রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠানে সন্ধ্যা ৬:৩০এ ইহলোক ত্যাগ করেছেন | তাঁর পুণ্যস্মৃতি রয়ে গেল, রয়ে গেল তাঁর রচিত গবেষণাগ্রন্থ রামকৃষ্ণসাহিত্যের যা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ |


বরুণ মহারাজের অবদান রামকৃষ্ণ ইতিহাসবেত্তা হিসেবে স্বামী গম্ভীরানন্দজীর পরেই সম্ভবত | তাঁর রচনাশৈলী ছিল তথ্যপূর্ণ, যুক্তিনির্ভর, বিজ্ঞানমনস্ক | অনেক নতুন তথ্য তিনি পেষ করেছেন ভক্তমণ্ডলের কাছে রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনবিষয়ক | তাঁর লেখা কয়েকটি বইয়ের নাম হল যথা:

১) The Early History of the Ramakrishna Movement 

২) First Meetings with Sri Ramakrishna 

৩) More about Ramakrishna 

৪) Journeys with Ramakrishna 

এই বইগুলি সব অমূল্য সম্পদ রামকৃষ্ণ ভাবানুরাগীদের কাছে |


মৃদুভাষী মানুষটি সহৃদয়, সহমর্মী ও অহংশূণ্য ছিলেন | ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল যার সুবাদে এই সহজ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম |


রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারের কর্ণধার হন পূজ্যপাদ লোকেশ্বরানন্দজীর দেহাবসনার পর | তখন তাঁর তত্ত্বাবধানে ইনস্টিটউটের বিশালকায় Annexe Buildingটি গড়ে ওঠে | লোকেশ্বরানন্দজীর পদাঙ্ক অনুসরণ করা সহজ কর্ম নয় কিন্তু বরুণ মহারাজ অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে তা করতে সক্ষম হয়েছিলেন যদিও সাপ্তাহিক কথামৃত ক্লাসে শ্রোতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় তা দ্বিসাপ্তাহিক করা হয় যা বরুণ মহারাজের বেলুড় মঠে সংঘের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে মাসিক করে দেওয়া হয় | কিন্তু ইনস্টিটিউটের গবেষণার কাজ বরুণ মহারাজের সম্পাদনায় সমান দক্ষতার সাথে সম্পন্ন হতে থাকে |


ব্যক্তিগতভাবে এই সময় একদিন আলাপ হয় মহারাজের সাথে আমার | বরানগর মঠের বিষয়ে তথ্য যোগাড় করার অভিপ্রায়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করি ইনস্টিটিউটে | চা ও বিস্কুটের বরাদ্দ করেছিলেন মহারাজ তাঁর দপ্তরে সকল দর্শনপ্রার্থীর জন্য যে প্রথা আজও অব্যাহত | তারপর মহারাজকে বরানগর মঠ বিষয়ক অনুসন্ধানসূচক প্রশ্ন করায় মুগ্ধ হয়েছিলাম তাঁর সম্পূর্ণ অহংশূণ্য ব্যবহারে ও তাঁর অলক্ষ্য আশীর্বাদে | আজ অন্য দিন | সে বিষয়ে আর বলছি না |


আরও দুবার গেছিলাম মহারাজের সাথে দেখা করতে | 


একবার রটে গেল গণমাধ্যমে স্বামীজীর শিকাগো বক্তৃতার রেকর্ড পাওয়া গেছে বলে | আমার হাতে এলো তার দু কপি সি. ডি. | আমি এই সংবাদটির ও সি. ডি. টির যাথার্থ নির্ণয়ের জন্য যখন মহারাজের কাছে গেলাম তখন ও বিষয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা হল | বরুণ মহারাজ বললেন যে ১৮৯৩ সালে অত দীর্ঘ বক্তৃতা রেকর্ড করার বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা ছিল না | এ বিষয়ে উনি মহিশূরের এক অধ্যাপকের সহযোগে গত পঞ্চাশ বছর ধরে গবেষণা করছেন বলে জানালেন | স্বামীজীর কন্ঠস্বরের দুটি রেকর্ডের কথা শোনা যায় যার এক কপি মহিশূরের রাজপরিবারের কাছে আছে | মহারাজ সেই কন্ঠস্বর শুনেছেন কিন্তু তা কালক্রমণে অত্যন্ত অস্পষ্ট | যদি দ্বিতীয় কপিটির সন্ধান মেলে তবে তার সাথে মিলিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যাবে যে ওই রেকর্ড দুটিতে স্বামীজীর কন্ঠস্বরই ধরা আছে | মহারাজ বললেন এরপর, "যাঁরা সে যুগে স্বামীজীকে শুনেছেন তাঁরা বলেছেন যে স্বামীজীর কন্ঠস্বর শুনলে গায়ে শিহরণ জাগে |" 


দ্বিতীয়বার গেলাম মহারাজকে আর একটি ভাল খবর দিতে | শিক্ষকতার কর্মের সুবাদে ভারতীয় ফুটবলের প্রবাদপুরুষ শ্রীযুক্ত চুনী গোস্বামীর সাথে পরিচয় হয় | মোহনবাগান ক্লাবের শতবর্ষ উদযাপনের সময় সমুপস্থিত জানতে পেরে ওঁকে এক প্রকার দাবী জানিয়ে বসি মোহনবাগান ক্লাবে স্বামীজীর মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং তার কারণ হিসেবে ফুটবল সংক্রান্তিয় স্বামীজীর বিখ্যাত উক্তি 'হে আমার যুবক বন্ধুগণ ! ... গীতাপাঠ ছাড়িয়া ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের অধিকতর সমীপবর্তী হইবে ...' স্মরণ করিয়ে দি | আশ্চর্য মানুষ চুনী গোস্বামী ! মুহূর্তে নির্দ্বিধায় রাজী হয়ে গেলেন ক্লাবের মিটিংএ কথাটি পারবেন বলে | আরো বলে চমৎকৃত করলেন যে স্বামীজী নাকি ক্রিকেট ও ফুটবল, দুই খেলাতেই কলকাতার টাউন ক্লাবের হয়ে প্রথম ডিভিসনে প্রতিনিধিত্ব করেছেন | এ বিষয়ে গোস্বামী মহাশয় অনেক আগে নিজে সংবাদটি কোথাও পড়েছিলেন, এখন আর সূত্র স্মরণ করতে পারছেন না, তবে খোঁজ করলে অবশ্য পাওয়া যেতে পারে | 


এর দু বছর পর একদিন চুনী গোস্বামীর ফোন পেলাম কর্মসূত্রে | উনি বললেন, "বোস সাহেব, স্বামীজীর আবক্ষ মূর্তি বসে গেছে মোহনবাগান ক্লাবে | এখন বলুন কি লিখতে হবে তার গায়ে |" আমি ওই 'গীতাপাঠ ছাড়িয়া ফুটবল খেলিলে' উক্টিটি সংক্ষিপ্ত করে দিতে বললাম | কাজ হল | গোস্বামী মহাশায় খবর দিলেন, "দলের ছেলেরা স্বামীজীকে প্রণাম করে মাঠে নামছে |" আমি বরুণ মহারাজের সাথে দেখা করে সব কথা বললাম | উনি বিরল উচ্ছাস দেখালেন | একমুখ হাসি ভরে বললেন, "করেছেন কি ? এ তো দারুণ খবর ! আর সত্যিই যদি স্বামীজী ক্রিকেট ফুটবল দুইয়েই টাউন ক্লাবের হয়ে ফার্স্ট ডিভিসনএ খেলে থাকেন, সে তো চাঞ্চল্যকর নতুন তথ্য হবে |" 


আর দেখা হয়নি মহারাজের সাথে সাক্ষাতে | আর আজ লিখছি এই |


১৯৮৪ সালে প্রথমবার দেখি মহারাজকে বেলুড় মঠে | তখন উনি মঠমিশনের অন্যতম সহসাধারণ সম্পাদক | 


বিগত দশক ধরে বরুণ মহারাজ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম সহসংঘাধ্যক্ষের পদ গৌরবের সাথে অলঙ্কৃত করেছেন | বহু আর্ত, পীড়িত, জিজ্ঞাসু, অধ্যাত্মপিপাসু মানুষ তাঁর কাছে ইষ্টমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে কৃতকৃতার্থ হয়েছেন | আজ তাঁদের বিশেষ দুঃখের দিন | কিন্তু তাঁরা এও নিশ্চয় অনুভব করছেন যে তাঁদের ভাগবতী তনুবদ্ধ ঈশ্বরপ্রতীম গুরু আজ মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় চিদাকাশে ভাসমান | তাঁর রোগাক্রান্ত দেহের কষ্ট হতে তিনি মুক্তি পেয়েছেন ও এখন অপার কৃপায় মর্তলোকে সূক্ষ্মদেহে অবস্থানকালে তাঁর শেষ আশীর্বাদ বর্ষণ করছেন | এ এক মহালগ্ন, এ এক মাহেন্দ্রক্ষণ যখন মহাপুরুষ চিরবিদায় নেন মর্তলোক হতে | কিন্তু তাঁর সে বিদায় তাৎক্ষণিক | প্রভুর প্রতিভূ হয়ে তিনি ভক্তশিষ্যের সহস্রারে নিত্য বিদ্যমান -- ছিলেন, আছেন, থাকবেন | জয় রামকৃষ্ণ ! হরি 🕉 রামকৃষ্ণ!


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment