Monday 15 May 2023

নারী জাগরণ








নারী জাগরণ

--------------


নারী জাগরণ যত হবে ততই সভ্য হবে মানুষ | তবে নারী জাগরণ অধ্যাত্ম জাগরণের সমার্থক হওয়া চাই | নইলে তা পাশ্চাত্যের অনুকরণে দেহসর্বস্যতায় পর্যবসিত হবে | আমাদের দেশের সনাতন আদর্শ নারীকে দেবীরূপে দেখেন কারণ মানুষ স্বরূপতঃ ব্রহ্ম | সেই ব্রহ্মবিকাশের উদ্দেশ্যেই সর্বজাগরণ | নারী জাগরণও সেই ব্রহ্মবিকাশেরই জন্য |


স্বামীজী বলেছিলেন, "একজন নারী যদি ব্রহ্মজ্ঞানী হন তো সহস্র নারী তাঁর দ্বারা উচ্চ জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত হবেন |" পারুল তথা সরলা তথা শ্রীভারতী তথা প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণা মাতাজী এমনই এক ব্রহ্মজ্ঞানী মহীয়সী যিনি বাল্যে ও কৈশোরে নিবেদিতা স্কুলে সিস্টারের সংস্পর্শে এসে ধন্য হয়েছিলেন, পরে যৌবনে শ্রীশ্রীমায়ের, গোলাপ মায়ের, যোগীন মায়ের ও স্বামী সারদানন্দজীর সেবা করে কৃতকৃতার্থা হয়েছিলেন | মায়ের কাছে তাঁর মন্ত্রদীক্ষা ও শরৎ মহারাজের কাছে কৌল সন্ন্যাস দীক্ষা লাভ হয় | শরৎ মহারাজের দেহ যাবার পর শ্রীভারতী (পারুল তথা সরলার কৌল সন্ন্যাস নাম) কাশীবাসি হন ও একান্তে সুদীর্ঘ সাতাশ বছর তপস্যারতা থাকেন | এই সময়ে তিনি আধ্যাত্মিক জগতের উচ্চ ভাবশিখরে আরোহণ করেন ও শ্রীভগবানের বিশেষ কৃপাধন্যা হন | পরে মায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বেলুড়র মঠের সপ্তম সংঘাধ্যক্ষ পূজ্যপাদ স্বামী শঙ্করানন্দজীর আহ্বানে নবগঠিত শ্রীসারদা মঠের প্রথম সংঘাধ্যক্ষার পদে বৃত হন |


এই ছিল এক মহাজীবন, স্ত্রীস্বাধীনতার উজ্জ্বলতম নিদর্শন | এমনটা কি হচ্ছে আজ?


স্বামীজী পত্রে লিখেছেন যে শ্রীশ্রীমায়ের জন্মের সাথে সাথে পৃথিবীতে শক্তির মহা উদ্বোধন হয়েছে | মর্তধামে তাঁর পুণ্য পদার্পণে নারী জাগরণ দিকে দিকে দেখা দিয়েছে | এই সুপ্ত মাতৃশক্তি জাগরণকল্পেই মায়ের এবার মনুষ্যশরীরধারণ | স্বামীজী তাই এমেরিকা থেকে গুরুভাইদের চিঠি লিখছেন মাকে কেন্দ্র করে স্ত্রীমঠ গড়ার জন্য | মায়ের জীবনাদর্শে গড়ে উঠবে শত শত পুণ্যবতী ত্যাগব্রতিনীর জীবন যাঁদের মধ্য হতে কালে গার্গী, মৈত্রেয়ী, উভয়ভারতীর ন্যায় ব্রহ্মবাদিনীর জন্ম হবে---এই ছিল স্বামীজীর স্বপ্ন | তাই নিবেদিতাকে বলেছিলেন তিনি, "Remember, women and the masses." ["মনে রেখো, নারী ও সর্বসাধারণ |"]


অনেক বাধাবিপত্তি, অনেক প্রতিকুলতা, রক্ষণশীলতা, সামাজিক লিঙ্গবৈষম্য অতিক্রম করে পরিশেষে ১৯৫৪ সালে শ্রীসারদা মঠ স্থাপিত হয় ও নারীমুক্তির সর্বোচ্চ সনাতন আদর্শের বাস্তব রূপায়ণের পথ পরিস্কার, পরিসর হয় | নিবেদিতা স্কুলকে কেন্দ্র করে যে নারীমুক্তির সূচনা হয়েছিল একদিন, তা দক্ষিণেশ্বরের সুরধনী কাননে শ্রীসারদা মঠে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়ে স্রোতস্বিনীরূপ ধারণ করল |


অবতার যখন আসেন, তখন তিনি তাঁর লীলাসঙ্গিনীকে নিয়ে আসেন | পূর্ব পূর্ব অবতারে তাঁদের শক্তিস্বরূপিনীরা অন্তরালেই থেকেছেন এক প্রকার | কিন্তু রামকৃষ্ণ অবতারে তাঁর লীলাসঙ্গিনীর পূর্ণ প্রকাশ স্বয়ং ঠাকুরই করে গেছেন | শ্রীরামকৃষ্ণের উপনয়নোত্তর প্রথম ভিক্ষাগ্রহণ ধাত্রীমাতা ধনী কামারিনীর নিকট, রাসমনীর কালীবাড়িতে ২৯ বর্ষ লীলাসংঘটন ও কালীমাতাকে ইষ্টদেবীজ্ঞানে নিয়ত অনুভব, সাধনকালে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর কাছে তন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ ও সাধনা, পরে স্বীয় পত্নীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা ও তাঁর দেহমনে ত্রিপুরাসুন্দরী জগদম্বার সাক্ষাৎ উপস্থিতির আবাহন, পরিশেষে শ্রীমা সারদা দেবীকে জগৎকল্যাণের জন্য নানা গুপ্তমন্ত্র শিক্ষাদান ও তাঁকে আহ্বান এই মহতী কর্ম সম্পাদনে---এই সমস্ত কর্মের পেছনে ঠাকুরের নারীজাতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও তাদের পতিত অবস্থা হতে উদ্ধারের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় | এমনকি, যখন গৌরীমা তপস্যার্থে পুনরায় হিমালয় গমনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন ঠাকুরের কাছে, তিনি বলেন, "আর কেন গৌরদাসী ? অনেক তো হল | কলকাতার মেয়েগুলোর অবস্থা দেখেছ ? তাদের জন্য লেখাপড়ার ব্যবস্থা করো |" গৌরীমার হিমালয়ে প্রব্রজ্যা আর হল না | তিনি রয়ে গেলেন রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের প্রথম বিদ্যালয় রচনার কর্মে | শুরু হল সারদেশ্বরী আশ্রম ও অবৈতনিক হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় যা ভারতীয় সনাতন পরম্পরায় আদর্শ হিন্দু নারীর জীবনগঠনে আজও ব্রতী |


অতএব, ঠাকুর-মা-স্বামীজী যে নারী জাগরণ দেখতে চেয়েছিলেন তা কিন্তু যা ঘটতে দেখছি আমরা তার থেকে অনেক আলাদা | তাঁরা নারীর মধ্যে বিদ্যাশক্তির উদ্বোধন চেয়েছিলেন, অধুনা অনুষ্ঠিত অবিদ্যাশক্তির প্লাবন চান নি | পাশ্চাত্যপ্রভাবে এই যে তথাকথিত নারীমুক্তি, এতে পার্থিব শিক্ষাসহায়ে নারীর সশক্তিকরণ অবশ্যই আছে কিন্তু এতে আধ্যাত্মিক কল্যাণ নেই | বরং অকল্যাণ আছে কারণ ব্রহ্মচর্যবিবর্জিত এই জড়শিক্ষালাভে নারীর প্রকৃত মুক্তিলাভ হবে না বরং সে নিজেকে দেহমনবিশিষ্টমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুরূপে দেখতে শিখে বিষয়তৃষ্ণার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে | পুরুষ চিরাচরিত দৃষ্টিতে তাকে ভোগ্যবস্তু ভাববে ও সে নিজেও নিজেকে তাই ভাববে, মুখে যতই বড় বড় নারীমুক্তির বাণী আওড়াক না কেন | দেহজ সম্পর্ককে কাব্যের অলঙ্করণে আবৃত করলেও তার করাল পরিণাম হতে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না | ফলে অশেষ বাসনাপীড়া ও পরিশেষে মৃত্যু | একে তো জাগরণ বলে না | এ তো মোহনিদ্রা !


ঠাকুর যেমন নিরন্তর পুরুষদের কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করতে বলেছিলেন, তেমনই মেয়েদের পুরুষকাঞ্চন ত্যাগ করতে বলেছিলেন | জীবনের উদ্দেশ্য যেখানে ঈশ্বরলাভ বলে নির্ধারিত হয়েছে যুগাবতারের বিচারে, সেখানে যা কিছু জনজাগরণকর্ম, সবই সেই নিমিত্ত অনুষ্ঠিত হওয়াই তাঁর অভিপ্রেত | তাতেই ইষ্টসিদ্ধি | তার বিপরীত কর্মে অনিষ্টলাভ যা আজ সামাজিক ব্যাধীরূপ ধারণ করেছে | কোথায় নারীমুক্তি ? নারী ক্রমবর্ধমান ভোগ্যবস্তুতে পরিণত আজ পুণ্যভূমি ভারতবর্ষের নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় | বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে, চলচ্চিত্রে, পোশাকপরিচ্ছদে, আচারব্যবহারে---সবেতেই আজ এক চূড়ান্ত অসংযমের পরিচয় | এই সংযমহীনতা পুরুষনারী নির্বিশেষে কিন্তু এই প্রবন্ধে নারী জাগরণের আলোচনা হচ্ছে, তাই নারীর বিষয়েই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল | এমনটি ঠাকুর-মা-স্বামীজী অবশ্যই চাননি যদিও ত্রিকালদর্শী দিব্যত্রয়ী সম্ভবতঃ সামাজিক বিবর্তনের এই অবধারিত ধারা পূর্ব হতেই পরিজ্ঞাত ছিলেন | কিন্তু তাই বলে কি তাঁদের আদর্শকে খর্ব করব আমরা ? মেনে নেব সামাজিক পতন অবশ্যম্ভাবী বলে ? নাকি সংগ্রাম করব, সহায়তা করব দেশের মেয়েদের অন্ততঃ ব্রহ্মচর্যের উচ্চ আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করতে? বলা বাহুল্য, এ ভাবাদর্শ পুরুষের জন্যও সমভাবেই প্রযোজ্য | তবেই তে সমাজ বৈদিক ভিত্তিতে গড়ে উঠবে, মানুষের দেবত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটবে বহুজনে, বহুজনসুখায় চ, বহুজনহিতায় চ |


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment