ছোটো মুখে বড় কথা কিন্তু সত্যবচন
ছোটো মুখে বড় কথা কিন্তু সত্যবচন
☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆
স্বামীজী তো সোজাসুজি কথা বলতেন, দুর্বৃত্তকে নাম ধরে দুর্বৃত্তই বলতেন, দুষ্টদর্শনকে নাম ধরে দুষ্টদর্শনই বলতেন | তাহলে তাঁর অনুগামীরা তাঁর পথ ছেড়ে মিঠে মিঠে কথা বলে হিন্দুদের দুর্বল করছেন কেন ? কেন 'টাকা মাটি মাটি টাকা'র পথ পরিত্যাগ করে ঐহিক সম্পদ আহরণে এত ব্যস্ত ? খালি দান আর দান---এর পেছনে এভাবে আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে ছুটলে হিন্দু রক্ষা পাবে ? ঠাকুরের যুগধর্মপ্রবর্তন হবে ? কোনো প্রচেষ্টাই নেই সত্যভাষণের | সর্বধর্মসমন্বয়ের অপব্যাখ্যা, অধর্মকে না রুখে তার সাথে কোনোমতে আপস, জ্বলন্ত বৈরাগ্যের পথ ছেড়ে মন্দাবৈরাগ্যের পথে গমন, চারিত্রিক তেজ হারিয়ে বক্তৃতায় শুধু মৃদুভাব, ঠাকুর-স্বামীজীর বাণীপ্রচারে এক প্রকার অনীহা, তাঁদের তেজোদ্দীপ্ত বাণীকে যথাযথ প্রচার না করে তার সম্পাদিত সংস্করণকে জনসমক্ষে রাখা, মঠমিশনে মৃদুসংগীত পরিবেশন, এমন কি সাধুদের হাত তুলে দুলে দুলে নৃত্য, এসব যা স্বামীজীর ভর্তসনার স্বীকার হয়েছিল,
["খোল-করতাল বাজিয়ে লম্ফঝম্প করে দেশটা উৎসন্নে গেল। একে তো এই dyspeptic (অজীর্ণ) রোগীর দল, তাতে আবার লাফালে ঝাঁপালে সইবে কেন? কামগন্ধহীন উচ্চ সাধনার অনুকরণ করতে গিয়ে দেশটা ঘোর তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে, গাঁয়ে গাঁয়ে যেখানে যাবি, দেখবি খোল-করতালই বাজছে! ঢাকঢোল দেশে তৈরি হয় না? তুরীভেরী কি ভারতে মেলে না ? ঐ-সব গুরুগম্ভীর আওয়াজ ছেলেদের শোনা। ছেলেবেলা থেকে মেয়েমানষি বাজনা শুনে শুনে, কীর্তন শুনে শুনে দেশটা যে মেয়েদের দেশ হয়ে গেল! এর চেয়ে আর কি অধঃপাতে যাবে ? কবিকল্পনাও এ ছবি আঁকতে হার মেনে যায়! ডমরু শিঙা বাজাতে হবে, ঢাকে ব্রহ্মরুদ্রতালের দুন্দুভিনাদ তুলতে হবে, 'মহাবীর, মহাবীর' ধ্বনিতে এবং 'হর হর ব্যোম্ ব্যোম্' শব্দে দিগ্দেশ কম্পিত করতে হবে। যে-সব music-এ (গীতবাদ্যে) মানুষের soft feelings (হৃদয়ের কোমল ভাবসমূহ) উদ্দীপিত করে, সে-সব কিছুদিনের জন্য এখন বন্ধ রাখতে হবে। খেয়াল-টপ্পা বন্ধ করে ধ্রুপদ গান শুনতে লোককে অভ্যাস করাতে হবে। বৈদিক ছন্দের মেঘমন্দ্রে দেশটার প্রাণসঞ্চার করতে হবে। সকল বিষয়ে বীরত্বের কঠোর মহাপ্রাণতা আনতে হবে। এইরূপ ideal follow (আদর্শ অনুসরণ) করলে তবে এখন জীবের কল্যাণ, দেশের কল্যাণ। তুই যদি একা এভাবে চরিত্র গঠন করতে পারিস, তা হলে তোর দেখাদেখি হাজার লোক ঐরূপ করতে শিখবে। কিন্তু দেখিস, ideal (আদর্শ) থেকে কখনও যেন এক পা-ও হটিসনি। কখনও সাহসহীন হবিনি। খেতে শুতে পরতে, গাইতে বাজাতে, ভোগে রোগে কেবলই সৎসাহসের পরিচয় দিবি। তবে তো মহাশক্তির কৃপা হবে।"
~ স্বামী বিবেকানন্দ]
তাই আজ নিত্যপ্রদর্শিত | ১৯৮০র দশকেও যে সংযম, যে তেজ বিক্রম দেখেছি সাধুদের, আজ তা কই ? তখন কত অনুপ্রাণিত হয়েছি | আজ আর হতে পাচ্ছি না যদিও ঠাকুর-স্বামীজী আজও নিত্য অনুপ্রেরণার স্থল | ভাববার বিষয় এই যে বৈষয়িক মায়ার আকর্ষণে একবার পড়লে তা কিন্তু একেবারে পতনের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যাবে | এ বিষয়ে স্বামীজীর কিছু সাবধানবাণীও পাই আমরা |
["The bane of every spiritual organisation is when it hangs onto the sleeves of the rich."
"90% of the monastics are slaves to name and fame."
"To organise or not to organise? If I organise, the spirit will diminish and if I do not organise, the message will not spread."
"Organisation breeds new evils."
~ Swami Vivekananda]
স্বামীজী বলেছিলেন, "The spiritual current that has hit the shores of Belur will last 1500 years."
আরও বলেছেন যে রামকৃষ্ণ মিশন কোনো ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভর করে থাকবে না | এ এক মহা নৈর্ব্যক্তিক শক্তির দ্বারা পরিচালিত হবে |
বলেছেন, "এই মঠের সাধুদের এক এক অঙ্গুলিহেলনে জগতের দূরদূরান্তে আধ্যাত্মিক তরঙ্গ প্রবাহিত হবে |"
বলেছেন, "উঠো, উঠো, মহাতরঙ্গ আসছে, সব ভেসে যাবে |"
এরকম অজস্র ভাবোদ্দীপক বাণী রেখে গেছেন যার যথাযথ বীর্যবান প্রচারে মহা জগতকল্যাণ সম্ভব | মৃদুভাষণে সম্ভব নয় | স্বামীজী পৌরুষের প্রদর্শন চাইতেন চলনেবলনে, হাবেভাবে, সাহিত্যেসংগীতে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতি পদক্ষেপে | জীবনয়ায়াহ্নে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, "My message may be summed up in one word---manhood."
কি বলব আর ? কত বলব ? মঠমিশন কর্তৃপক্ষের এসব ভাবা উচিত ও সেইভাবে সংঘ পরিচালনা করা উতিত যাতে ঠাকুর-স্বামীজীর ভাব অক্ষুণ্ণ থাকে, যুবসম্প্রদায় সনাতন ধর্ম পালনে, রক্ষায় নিয়োজিত থাকে ও আদর্শহীনতায় পথভ্রষ্ট না হয় | এসব কথা বেদনার সাথে ব্যক্ত করলাম কারণ জীবনটাই তো দিলাম ঠাকুর-স্বামীজীর মিশনের জন্য | অপরাহ্নবেলায় এ হেন আদর্শত্যূতি দেখে ব্যথিত হই, নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মায় যে আমিও কিছুই করতে পারলাম না এই দিব্যদেবদ্বয়ের জন্য | বৃথা গেল এ জন্ম | সমালোচনা করতে ঠাকুর-মা-স্বামীজী-গুরুদেব বারণ করেছেন, তবুও করলাম এই আশায় যদি বার্তা পৌঁছোয় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে | জয় রামকৃষ্ণ !
রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)
No comments:
Post a Comment