Tuesday 10 May 2022

সখীভাব তো অনেক হল | এবার বীররসের সঞ্চার হ'ক |


সখীভাব তো অনেক হল | এবার বীররসের সঞ্চার হ'ক |

--------------------------------------------------------------------------


বাংলা ভাষাটাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে শব্দের সমস্ত দুর্বলতা দূর করে | রামমোহন রায় আর স্বামী বিবেকানন্দের লেখা অনুধ্যান করলে এ ব্যাপারে সূত্র পাওয়া যাবে | চরিত্রের পৌরুষ থেকেই ভাষার পৌরুষ আসে | হাবভাব যার মেয়েলী, তার কি ভাষা দৃপ্ত হবে ? সংগীতপরিবেষণার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায় | হাঁটাচলা, ওঠাবসা, কথা বলা, সাহিত্যচর্চা, লোকব্যবহার -- এই সমস্ত কিছুতেই বলিষ্ঠ ভাব রক্ষা করতে হবে | ইন্দ্রিয়াসক্তি কমলে এই দৃঢ় ভাব প্রকাশের সম্ভাবনা বেশী | লোকমান্যের ইচ্ছা ত্যাগ করলেও পৌরুষ প্রকাশিত হয় অধিক | আমাদের বাংলা ভাষার লিখিত প্রয়োগে এমনভাবে এই কোমলতা ঢুকে গেছে যে এই মুহূর্তে প্রতিপদে আমার এই লেখাও একইভাবে দুষ্ট হয়ে চলেছে | ভাষার বিপ্লব প্রয়োজন | কিন্তু তা প্রায় অসম্ভব যতক্ষণ না এই বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ যথার্থ পুরুষমানুষের জন্ম হচ্ছে | এখন তো প্রায় সবই মেয়েলী পুরুষ | পুরুষপ্রবর রাসবিহারী বসু একথা বলেছিলেন বাঙালীদের সম্বন্ধে | সে দুর্দশা আজও ঘোঁচেনি | স্বামীজীর মন্তব্যও এবিষয়ে একই |


বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে মানুষের বিবর্তন নাকি এমন ধারাতেই চলেছে যে পুরুষ ও নারীর লিঙ্গগত মানসিক প্রভেদ ক্রমশঃ অপসারিত হচ্ছে | অর্থাৎ, পুরুষ ক্রমশঃ মেয়েলী আর নারী ক্রমশঃ পুরুষালী হচ্ছে | এর কারণ সম্ভবত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে শারীরিক শক্তির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমে যাচ্ছে বলে | সমস্যা সেখানে নয় | সমস্যা হল যখন বাংলার ছেলেমেয়েরা উভয়েই অধিকতর ইন্দ্রিয়াসক্তিকে সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং হাবেভাবে, চলনেবলনে, সাহিত্যসংগীতচর্চায় ও জীবনযাপনে দুর্বলতাকে সবলতা জ্ঞান করছে | এতে ইন্ধন দিচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাধুসন্ন্যাসীরাও যাঁরা স্বামীজীর অনুসারী হয়েও তাঁর ভাবাদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন |


তেমন মেয়েই বা কেথায় যারা বীর পুত্রকন্যার জননী হতে পারে ? ভুবনেশ্বরী দেবী জন্মালে তবে তো নরেন্দ্রনাথ জন্মাবে | ভয়ানক সমস্যা ! ইন্দ্রিয়পরায়ণতা এমনভাবে বাঙালী সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে এই কাব্য-সাহিত্য-সংগীত-সংস্কৃতির আড়ালে যে গোটা সমাজে ঘুণ ধরে গেছে | শিক্ষা হয় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির নিম্ন অনুকরণে পরিণত নয় রবীন্দ্রনাথ প্রমুখকে কেন্দ্র করে নিজ চারিত্রদু্র্বলতা ও ইন্দ্রিয়াসক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া | এমনকি যারা কমিউনিস্ট তারাও এই একই ভাবে ভাবিত, একই দোষে দুষ্ট | যাবে কোথা ? মার্ক্সবাদী হলেও বাঙালী তো ! শ্রেণীসংগ্রামের নামেও ইন্দ্রিয়পরায়ণতা ! একই কথা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দপন্থীদের সম্বন্ধেও প্রযোজ্য | সেই পানসে, দুর্বল, মেয়েলী ভক্তিভাব, কেঁদে কোঁকিয়ে 'ঠাকুর কৃপা করো', সেই প্রতিটি অনুষ্ঠানের শুরুতে, মাঝে ও শেষে অযোগ্য বিখ্যাত সন্ন্যাসী গায়কের হাতে মাইক তুলে দিয়ে প্রোগ্র্যাম পণ্ড করার অভিনব উপায় অবলম্বন, যে অসংগীত শুনলে মা সরস্বতীরও কান পচে যায়, তাই ভক্তগণ ও সাধুরা মুগ্ধচিত্তে শুনে ধন্য বোধ করেন -- এই না হলে সভ্যতার সংকট ?


উপায় আছে | নাচগানকবিতাটা একটু কমিয়ে শরীরচর্চা, খেলাধূলা, সামরিকশিক্ষা -- এই উপায়ে মনের দৃঢ়তা বাড়বে, মেয়েলী ভাব উপশম হবে, ভাব চাপবার ক্ষমতা বাড়বে | দুর্বল শরীরের ব্যারাম এই নাটুকে ভাবে গলা কাঁপিয়ে কবিতা পড়া অথবা কোন অনুষ্ঠানের সূত্রধরের কাজে কম্পিতকন্ঠপ্রয়োগ | যেমন ধরুন -- "নমস্কার বন্ধুরা | আজ আমরা এই শুভসন্ধ্যায় সমবেত হয়েছি সেই বীর যতিবর স্বামী বিবেকানন্দের স্মরণে/আমাদের পরম শ্রদ্ধার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে |" কথাগুলোয় মেয়েলী ভাব যত না আছে তার থেকে ঢের বেশী আছে বাচনভঙ্গীতে | গলা কাঁপিয়ে, শ্রোতাদের মুগ্ধ করার কপটপ্রয়াসে বাচনভঙ্গীর মায়া অবলম্বনে পুরো আবহাওয়া পণ্ড করা, এই আর কি | এ তো নিত্য হয়ে চলেছে কিন্তু কারো কোন ভ্রূক্ষেপই নেই | বোধ থাকলে তো ভ্রূক্ষেপ হবে !


লেখক : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment