Thursday 1 June 2023

কেন মুখ বুজে সইতে হয় শত অপমান ?



কেন মুখ বুজে সইতে হয় শত অপমান ?

-----------------------------------------


মার্ক্সবাদী মুখে হওয়া যত সহজ, দার্শনিক চিন্তায় হওয়া ততটাই কঠিন | প্রতিটি অর্বাচীনই তো আর দার্শনিকভাবে মার্ক্সবাদী নন | তাঁরা কোলাহলরত, হলাহলক্ষেপণকারী, অপসংস্কৃত, আত্মঘাতী, স্বদেশবৈরীর দল যাঁরা সনাতন সভ্যতার সর্বনাশ সংঘটনে তৎপর | এঁদের ইতিহাস সাম্যের নামে রক্তে রঞ্জিত | দেশবিভাগে এঁদের নেতাদের অবদান অনস্বীকার্য, অবিস্মরণীয় | এঁরা বিষয়বিমোহিত বাঙালীর অভিনব সংস্করণ | এঁরা যে ভারতের সনাতন আধ্যাত্মিক সংস্কৃতিতে অনাস্থাপর হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক | ব্রহ্মচর্যহীন, ভোগসর্বস্ব, স্বল্পধী, বিষয়বিক্ষিপ্ত মানুষ কি অত্যুচ্চ অধ্যাত্মসম্পদ সম্বন্ধে ধারণা করতে পারেন ? জন্মজন্মার্জিত শুভ সংস্কার কই ? উপযুক্ত আধার কই যে মহান অধ্যাত্ম আদর্শ সম্যক ধারণা করতে সক্ষম হবেন এঁরা ? শুধু কাকবুদ্ধি থাকলেই বুঝি শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ হওয়া যায় ? ঠাকুর কি বলেছেন ? "কাক বড় চালাক কিন্তু বিষ্ঠা খেয়ে মরে |" মা ঠাকরুণকে বললেন, "কলকাতার লোকগুলো অন্ধকারে কিলবিল করছে | ওদের তুমি দেখো |" আবার বলছেন, "লোক না পোক |" যে সব চেলারা তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন, তাঁদের সম্বন্ধে কেশব সেন বলছেন ঠাকুরকে, "মশাই, যাবার সময় আবার গালমন্দ করে গেল |" উত্তরে ঠাকুর কি বললেন ? "তাতে কি ? তারা তো সব হরে প্যালা পঞ্চার দল |"


অতএব, এইসব বিকৃতবুদ্ধি, অপসংস্কৃত, বিষয়বিমোহিত, ব্রাহ্মণকলঙ্ক, বাকসর্বস্ব, অহংস্ফীত, কূপমণ্ডুক, কাপুরুষ বাঙালীর প্রলাপবাক্যে ব্যথা না পেয়ে তাঁদের সগৌরবে অগ্রাহ্য করে নিজ সনাতন সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই শ্রেয় | এঁরা নামে মাত্র মার্ক্সবাদী, বুলি আওড়ানো বাঙালী, জাতির কলঙ্ক | ভ্রষ্ট ব্রাহ্মণদের মাঝেই এই শ্রেণীর মানুষের আধিক্য |


এঁদেরও যুক্তি আছে, আছে ক্ষোভ ও আদর্শবিদ্বেষ ধনতন্ত্রের অপ্রতিহত তৃতীয় রিপুর বিজয়োল্লাসের বিরুদ্ধে | এঁরা ধনতন্ত্ররূপ শোষণযন্ত্রের বিরোধিতা করছেন, লোভরূপ বিষবৎ রিপূর বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে নিরলস সংগ্রামে রত, সে আমাদের মতে ভ্রান্ত জড়বুদ্ধিচালিত হয়েই হোক আর উচ্চ মানবিকতার দ্বারা প্রণোদিত হয়েই হোক না কেন | এঁদেরও আদর্শ আছে, আছে গভীর দর্শনশাস্ত্র যার অনুধ্যান করে থাকেন মার্ক্সীয় বিদ্যদ্জন ও নেতৃস্থানীয়েরা | সাধারণ কর্মীরা (cadre) দার্শনিক নন | তাঁরা অতশত বোঝেন না | নেতা যা বলেন, তাই শোনেন, তাই বোঝেন ও সেইমত চলেন | এঁরাই হলেন মার্ক্সীয় কপিবাহিনী | মার্ক্সীয় ধর্মের ধ্বজাধারীরা কখনও এঁদের পেছনে রেখে, কখনও সামনে রেখে বিপ্লববুলী আওড়ান | এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে ? সনাতন ধর্মজগতেও তো তথইবচ |


আমরা যাঁরা অল্পেই আহত বোধ করি কেউ আমাদের ধর্ম সম্বন্ধে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করলে, ক্রোধে ক্ষিপ্তপ্রায় হই, সত্যি কতটা আমরা ধর্মচর্চা করি বলুন তো ? ভোগসর্বস্ব জীবনে গা এলিয়ে দিয়ে, কজন সাধু ও অধ্যাত্মপ্রতিষ্ঠানের পদলেহন করে আত্মসম্মানবিবর্জিত হয়ে কালাতিপাত করি আর কেউ কিছু বললেই বড় গায়ে লাগে ? এটা ভাবের ঘরে চুরি নয় ? মার্ক্সবাদীরা তো কিয়ৎ নিজদর্শন সম্বন্ধে অবহিত কারণ তাঁরা সে বিষয়ে পড়াশোনা করেন | আমরা সনাতনীরা তা করি কি ? আমাদের তো আজ প্রকৃতিই প্রতিকৃতিময়, ভাবনাচিন্তাবিহীন ছবিসর্বস্ব ভগবদ্ভক্তি | আধ্যাত্মিকতা তো ছবি নয়, ভাবগম্ভীর বোধবিষয়ক সত্যবস্তু | তার প্রতি আগ্রহ আমাদের কতটুকু ? শুধু গালি খেলেই খারাপ লাগে, নিত্যদিন নিজজীবনে সনাতন সংস্কৃতিকে অবহেলা করলে, সনাতন ধর্মের গ্লানি দেখেও প্রতিকারের সামান্য প্রয়াস না করলে, আভ্যন্তরীণ ঘূণ দূরীকরণের প্রচেষ্টা না করলে খারাপ লাগে না ? কই, কারোর মধ্যে তো সনাতন ধর্মের প্রতি যথার্থ প্রেম দেখি না, বিপদক্লিষ্ট সাধারণ সনাতনীর পাশে সাহস করে দাঁড়াতে দেখি না | এই বুঝি ধর্মবোধ ? এই বুঝি স্বধর্মের প্রতি অনুরাগ ? কোথা আদর্শ ? কোথা প্রয়োগ ?


আজ হিন্দু সমাজ আক্রান্ত চতুর্দিকে | অর্থলোলুপ, ক্ষমতালোভী ভণ্ড গুরুতে ভরে গেছে দেশ যাঁরা বড়লোক ও রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের ধামাধরা | এমনকি স্বনামধন্য আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানগুলিও আজ লোভের দাস, কাঞ্চনের কাঙাল | আদর্শকে হত্যা করে আজ হোমাহূতি চলেছে | কোথায় গোকুলনন্দনের সামান্য জীবন ? কোথায় সিংহনিনাদকারী চক্রধারী বাসুদেবমূর্তি ? কাপুরুষতায় ছেয়ে গেছে সনাতন সমাজ | ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, বিষয়বিহ্বলতা ও হীনবীর্যতায় আচ্ছন্ন হিন্দু সমাজ | এইমাত্র সম্বল করে বুঝি আমরা স্বধর্ম রক্ষা করব ? এ কি কাপুরুষের কাজ ? কেন এই জঘন্য অধঃপতন ? কেন স্বামীজীর বলিষ্ঠ বাণী আজ বাঙালীর ঘরে ঘরে অনাদৃত ? কেন ইন্দ্রিয়পরবশ নৃত্যগীতকাব্যসাহিত্যকলাশিল্প যা মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান ও মনিপুর চক্রে মানুষকে আবদ্ধ রাখে, তা নিয়ে বাঙালী মত্ত ? কেন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রতি অনাদর আর মার্ক্স-রবীন্দ্রনাথের প্রতি এত অধিক আদর ? ভাববার বিষয় | শুধু গাল দিলে তো হবে না | ইন্দ্রিয়পরায়ণতা যেমন এর মূল কারণ, তেমনি সনাতনী হয়ে স্বধর্ম যথার্থভাবে পালন না করাও অন্যতম কারণ | এর জন্য দায়ী কে ? কেন ? আপনি, আমি | তাই অপমানের প্রতিকার আত্মসংশোধনের দ্বারা, আত্মোন্নয়নের বলে, প্রবাহিত বিশুদ্ধ জ্ঞান ও প্রেমের শক্তিতে সাধিক হোক | তাই হবে স্বধর্মরক্ষা | তাই হবে বৈরীভাবাপন্নের প্রতি যথাযথ প্রতিশোধ | 🕉 


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment