Sunday 22 January 2023

'যত মত, তত পথ' -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ১ -- ৮





বাংলাদেশে ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় সংঘটিত মুসলমান মৌলবাদী কর্তৃক হিন্দুনিধনযজ্ঞের প্রতিবাদে রচিত প্রবন্ধমালা [একত্র পুনঃপ্রকাশন]


'যত মত, তত পথ' -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ...  ১

----------------------------------------------------------------------------


বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদীদের বর্বর আক্রমণের দ্বারা আজ হিন্দু সমাজ ব্যাপকভাবে আক্রান্ত | বিষয়টি সকলেই অবগত আছেন | তাই তার বিবরণে এই উপস্থাপনায় আর যাচ্ছি না | হিন্দু সমাজ আজ প্রতিবাদে সরব বিশ্বের সর্বত্র | এরই মধ্যে কোনও কোনও মহলে কথা উঠছে রামকৃষ্ণ মিশনের হিন্দু সমাজ সংরক্ষণের কাজে ভূমিকা নিয়ে ও তাঁদের পালিত শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমুখনিঃসৃত বাণী 'যত মত, তত পথ'এর যাথার্থ নিয়ে, বিশেষতঃ গত ১০০ বছরের মুসলমান কর্তৃক হিন্দু গণহত্যা ও দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে |


'যত মত, তত পথ' যুগাবতার বলেছিলেন তাঁর নানা ধর্ম সাধনার পর চূড়ান্ত উপলব্ধি থেকে | সাথে সাথে তিনি এমন আরও অনেক কথাই বলেছিলেন যা 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে' লিপিবদ্ধ আছে | সেগুলি প্রণিধানযোগ্য | উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ''আধুনিক ধর্ম সব আসবে যাবে, এক সনাতন ধর্ম থাকবে | তবে একেবারে যাবে না, ওই একটু একটু থাকবে |" আবার, "ধর্ম কিছু ঈশ্বর নয় |" অথবা "মতুয়ার বুদ্ধি ভালো নয় | ... আমার ধর্মটি ঠিক আর অপরের ধর্ম ভুল, এ ভাব ভালো না | ... সব পথ দিয়েই তাঁকে পাওয়া যায় |" আবার বলছেন ঠাকুর, "সবাই বলে, আমার ঘড়ি ঠিক কিন্তু এক সূর্যই ঠিক চলছে |" শ্রীরামকৃষ্ণের এই উক্তিগুলি পরস্পর বিরোধী তো নয়ই, তারা একে অপরের পরিপূরক | অতএব, গোল তৈরী হয় তখন যখন স্লোগানরূপে একটি বাণীর বেশী প্রচলন হয়ে পড়ে তার ভাষাগত সংক্ষিপ্তকরণের জন্য অথবা প্রচারকর্মের রাজনীতির জন্য |


মহাপুরুষের উপলব্ধি তুরীয় স্তরের | তার প্রয়োগ যখন বাস্তব জগতে হয় তখন তার রূপ প্রায়ই পরিবর্তিত হয়ে যায় কতক, এমনই দেখা যায় | এর কারণ দুটি | এক, মহাপুরুষের বাণী তাঁর অনুগামীরা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে সক্ষম হন না ; দুই, ব্যবহারিক পরিস্থিতি সে বাণীর পূর্ণ প্রচার, প্রয়োগ ও প্রণয়নে বাধাস্বরূপ হয়ে ওঠে সাংগঠনিক দিক দিয়ে | এ অবস্থায় সত্যের প্রতিষ্ঠানিক রূপটি আদত সত্য থেকে পৃথক হয়ে পড়ে | ফলে জনমানসে মহাপুরুষের বাণীর সত্যাসত্য বিষয়ে বিভ্রান্ত্রির সৃষ্টি হয় | 


এখন এখানে অনেকগুলি প্রশ্ন এসে যায় |

১) 'যত মত, তত পথ' -- এই বাণীটির যাথার্থ তাত্ত্বিক দিক দিয়ে ও ব্যবহারিক দিক দিয়ে কতদূর ?

২) রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাতিষ্ঠানিক আদর্শগত অবস্থান কি ও তা জটিল রাজনৈতিক পরিবেশে পরিণত করা কতটা সম্ভব এবং তাঁদের ওপর সে বিষয়ে দায়ভারই বা কতটা বর্তায় ?

৩) রামকৃষ্ণ মিশন কি শুধুমাত্র একটি সন্ন্যাসী প্রতিষ্ঠান, নাকি তা সন্ন্যাসী ও গৃহীর যুগ্ম সহযোগে চলা একটি প্রতিষ্ঠান ? স্বামীজী কি চেয়েছিলেন ? ঘটনাপ্রবাহে তার কার্যত অবস্থান কি ?

৪) রামকৃষ্ণ মঠ কেন নবি দিবস পালন করেন কোনও কোনও শাখা কেন্দ্রে যেমন বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্রে ? কেনই বা তাঁরা যীশুর আবির্ভাব দিবসের পূর্বসন্ধ্যা পালন করেন ? কেনই বা বুদ্ধপূর্ণিমা পালন করেন ? কি তাঁদের সর্বধর্ম সমন্বয়ের ভাব ও বার্তা এবং কেন ?


প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে | 


ক্রমশঃ 


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)


যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ২

-------------------------------------------------------------------------


বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর মুসলমানকর্তৃক দেশব্যাপী যে অকথ্য অত্যাচার হয়ে চলেছে তাতে রামকৃষ্ণ মিশন দৃপ্ত প্রতিবাদ, মানববন্ধন আয়োজন ও ত্রাণকর্ম করা সত্ত্বেও কোনও কোনও মহলে কথা উঠেছে যে তাঁদের পালিত শ্রীরামকৃষ্ণ কথিত 'যত মত, তত পথ' হিন্দুদের এই দুর্দশার জন্য কতকটা দায়ী | এই অভিযোগ এসেছে যে হিন্দুরাই এই সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী মেনে চলেন, মুসলমানরা তা মানেন না | অতএব, হিন্দুর এই মহাপ্রাণতাই আজ তার দুর্গতির কারণ ও রামকৃষ্ণ মিশন পরোক্ষভাবে অন্ততঃ তার জন্য দায়ী | এই অভিযোগের সত্যাসত্য কতদূর তা নিয়েই আজকের পর্যালোচনা ও আমার এই প্রতিবেদন |


আমি শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীমা সারদা দেবী ও স্বামী বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিতজন | মিশনের বহু প্রাচীন সাধুর স্বল্পাধিক সঙ্গলাভ করেছি ও তাঁদের স্নেহাশীষ পেয়েছি | মিশনের সেবাকর্মের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা সময়ে সম্পৃক্ত থেকেছি | রামকৃষ্ণ মিশনই আমার প্রাণ, আমার আদর্শস্থল ও আমার সহায়, সম্বল, আত্মপরিচয়ের আলোকবর্তিকা | সেই হেতু এই আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে একদিকে যেমন দ্বিধা বোধ করছি, অপর দিকে তেমনই তা কর্তব্য মনে করছি | বিশ্লেষণে ভুল থাকলে নিজগুণে ত্রুটিবিচ্যুতি মার্জনাপূর্বক তা সংশোধন করে দেবেন | এতে সত্য যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে | শ্রীশ্রীঠাকুর আমার এই আলোচনায় সহায় হোন |


শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সাধনকালে সনাতন ধর্মের এক একটি পন্থা অবলম্বন করে পর্যায়ক্রমে সাধন করেন ও সিদ্ধিলাভ করেন | পরিশেষে নিজের আধ্যাত্মিক পিপাসা ও ধর্মবিষয়ক অপার কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য তিনি ইসলাম ও খ্রীষ্ঠধর্ম সাধন করেন এবং যথারীতি সিদ্ধিলাভ করেন | এরপর তিনি তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি করেন যা যুগাবতারের মহামন্ত্ররূপে আজ পরিগণিত | 'যত মত, তত পথ' সেই মহামন্ত্র যা বর্তমানে বাংলাদেশে হিন্দুনিধনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে |


'যত মত, তত পথ' -- এটি তো সনাতন ধর্মেরই শাশ্বত বাণী যা এযুগে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে সাধনরূপে ও বাণীরূপে মূর্ত হয়েছে | এখন প্রশ্ন হল ইসলাম ও খ্রীষ্ঠধর্ম এ বাণী মানে কি না ? তাদের ধর্মগ্রন্থে নিজধর্ম ভিন্ন অন্য কোনও ধর্মকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি | বর্তমান রচনায় বাংলাদেশের হিন্দু নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু ইসলাম ও তার প্রবল সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার কথাই আলোচ্য রাখব 'যত মত, তত পথ' এই বাণীর সংযোগে | 


শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সুফি ইসলাম গুরু গোবিন্দ রায়ের কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন ও সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন কিন্তু ইসলাম ধর্মে প্রথাগতভাবে নিজে ধর্মান্তরিত হন নি | এ ভারী অদ্ভূত ব্যাপার, ইসলাম ধর্মের বিরোধী এক একক অবস্থান ! কেমন করে তিনি ঐ ধর্ম সাধন করলেন তাঁর মুসলমান গুরুর কাছে নিজের হিন্দু ধর্ম ত্যাগ না করে ও ইসলামকে চিরকালের জন্য কুবুল না করে ? আর যদি গোবিন্দ রায় শ্রীরামকৃষ্ণের উচ্চ আধার ও ভাবাবস্থা দেখে সে ব্যবস্থায় রাজী হয়ে তাঁকে ধর্মান্তরিত না করেই সুফি সম্প্রদায়ের ইসলাম সাধনা করাতে সম্মত হন, তাহলে তো শ্রীরামকৃষ্ণ বাহ্যতঃ একটি দিনের জন্যও মুসলমান হননি, বরং বাহ্যতঃ হিন্দু থেকেই সুফি ইসলামের আভ্যন্তরীণ গূঢ় সাধনা করেছিলেন | ব্যবহারিক দিক দিয়ে আজকের সাম্প্রদায়িক বাতাবরণে অসম্ভব বলে মনে হলেও ভারতের ইতিহাসে হয়ত এমন কখনও কখনও হয়ে থাকতে পারে এই রকম ব্যতিক্রম | তাহলে কি শ্রীরামকৃষ্ণের ইসলাম ধর্মে সাধনা ও সিদ্ধিলাভ বাতিল হয়ে গেল ? গৌণ ধর্মাবলম্বীরা তাই বলবেন অবশ্যই কিন্তু মুখ্য ধর্মামবলম্বীরা তা বলবেন না | অতীন্দ্রিয় সত্যলাভ করাই ধর্মের উদ্দেশ্য | শ্রীরামকৃষ্ণের ন্যায় মহাপুরুষের অধ্যাত্ম সাধনার যোগ্যতা ও পরমহংসরূপে তাঁর সমাজের নিয়ম বহির্ভূত হওয়ার কথা গণ্য করেই গোবিন্দ রায় সম্ভবতঃ তাঁকে প্রথাগত নিয়ম না মেনেই দীক্ষা প্রদান করেন ইসলাম ধর্মে এবং ফলতঃ শ্রীরামকৃষ্ণের ইসলাম ধর্মের সোপান বেয়ে অদ্বৈত মহাসাগরে ব্রহ্মানুভূতিই প্রমাণ করে তাঁর ইসলাম ধর্মসাধনার সার্থকতা যদিও তা ইসলাম ধর্মের তত্ত্বগত যাথার্থের প্রমাণ দেয় না | শ্রীরামকৃষ্ণের সাফল্য মানুষের অধ্যাত্ম উপলব্ধির সম্ভাবনাকে জগদ্ব্যাপী বিস্তৃত করে কিন্ত ইসলামের মূল তাত্ত্বিক দর্শনের সত্যাসত্য নিরূপণ করে না |


অবতার তাঁর তুরীয় চেতনার স্তরে অবস্থান করে ধর্ম সম্বন্ধে যে রায় দেন তা কার্যতঃ সর্বসাধারণের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে প্রায়ই প্রয়োগ হয় না | সেখানে ঐক্যের বাণী বিভাজনের রাজনীতিতে পরিণত হয় | তাই এত বিদ্বেষ, বৈষম্য, ব্যভিচার সেই ধর্মের বাহিরমহলে যার অন্দরমহলে প্রবিষ্ট মহাপুরুষ শুধু প্রেমেরই গাথা গেয়ে গেছেন | এখন প্রশ্ন হল এই, শ্রীরামকৃষ্ণ যে ইসলাম ধর্ম সাধন করেছিলেন সেটি কি আদতে ইসলাম ধর্ম যেমনটি কুরানে লিপিবদ্ধ নাকি তিনি সুফি মতাবলম্বী গোবিন্দ রায়ের শিক্ষায় আদত ইসলাম নয়, আদি ইসলামের এক পরিবর্তিত, পরিণত, উন্নত, দরদী ভারতীয় সংস্করণ পালন করেছিলেন ? গোবিন্দ রায় কি তাঁকে আদত, ভয়ানক বিধর্মিবিদ্বেষি, বিধ্বংসী ইসলামের কথা আদপে বলেছিলেন ও সেইমত প্রচলিত হিন্দুধর্মের বিরোধী সব আয়াতের শিক্ষা দিয়েছিলেন ? নাকি গুরুশিষ্যের মধ্যে শুধু ঐ বিশেষ এক সুফি ইসলাম সম্প্রদায়ের সাধনপ্রণালী নিয়েই আলোচনা ও সাধনা সম্পন্ন হয়েছিল ?


দ্বিতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)


যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ৩

-------------------------------------------------------------------------


শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর দিব্য অনুভূতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বললেন, "যত মত, তত পথ |" পৃথিবীর মানুষ শুনল এক নতুন বাণী | রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের সূচনা হল জগতে |


এখন বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হল এই যে 'যত মত, তত পথ' সনাতন ধর্মের তাত্ত্বিক দিক দিয়ে সত্য হলেও ব্যবহারিক দিক দিয়ে তা কতদূর ফলপ্রসূ বিশ্বে আজ, বিশেষতঃ ইসলাম অধিকৃত দেশে ? কতদূর এই উদার বাণীর কার্যকারিতা যখন ইসলামের শাস্ত্রগত মূল নীতি ও তত্ত্ব এই সর্বমত সহিষ্ণুতা ও পরস্পর পরস্পরের ভাবগ্রহণের বিরোধী ? ইসলাম একমাত্র নিজেকেই সর্বোৎকৃষ্ট, নিখুঁত ধর্ম বলে ঘোষণা করে, কুরানকে আল্লাহ্'র বাণী বলে সমস্ত মানবজাতির ওপর বাধ্যতামূলক আরোপ করতে প্রবৃত্ত হয় ও মুহম্মদকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর বলে চিহ্নিত করে | ইসলামের এই বিচারে সনাতন ধর্ম তথা পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম আংশিক অথবা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, হিন্দুধর্মের বিগ্রহপূজা যা শ্রীরামকৃষ্ণ করতেন, তা ভ্রান্ত ও, যেহেতু মুহম্মদ-পরবর্তি আবির্ভাব শ্রীরামকৃষ্ণের, অতএব তিনি সামান্য মানুষমাত্র, পয়গম্বর নন, অবতার তো ননই কারণ ইসলাম অবতারতত্ত্ব মানে না ও আল্লাহ'র আসনে আর কাউকে স্থান দেয় না | কুরান ও হাদীস অনুযায়ী শ্রীরামকৃষ্ণের ইসলাম সাধনা নাজায়েজ্ কারণ তিনি ইসলাম ধর্মে আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মান্তরিত নন, সেই সাধনার পর তিনি পুনঃ বিগ্রহ পূজা করেছেন যা ইসলামে গর্হিত অপরাধ ও তাঁর ইসলাম ধর্মসাধনার পর উপলব্ধি সনাতন ধর্মের সাথে মেলে, কুরানে কথিত তত্ত্বের সাথে বিশেষভাবে নয় |


সনাতন ধর্মের চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক সিদ্ধান্ত অদ্বৈতজ্ঞান | অদ্বৈত অনুভূতিই সনাতন ধর্মের প্রাণ | মুক্তি, মোক্ষ আত্মার সর্বশেষ পরিণতি | ইসলামে এই অদ্বৈতজ্ঞান যা ব্রহ্মজ্ঞান অথবা আত্মজ্ঞানরূপেও কথিত, তার কোনো উল্লেখ নেই | এ তত্ত্ব ইসলামের অবিদিত যদিও আনাল হক্ বলে এর নামান্তরের কথা আমরা শুনতে পাই ইসলামী ইতিহাসে যার প্রবক্তাকে অনঐসলামীক তত্ত্বপেশের জন্য নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল |


অতএব, তিনদিনের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ যদিও সুফি মুসলিম গোবিন্দ রায়ের দীক্ষিত 'আল্লা' মন্ত্র জপ করেছিলেন ও ইসলামধর্মের চূড়ান্ত সাধনফল লাভ করেছিলেন বলে 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গে' বর্ণিত আছে, সেই সাধনফল আসলে কি এবং তা আদপে আদি ইসলামের সাথে মেলে কি না ? না কি তা সনাতন ধর্মের আধ্যাত্মিক তত্ত্বের সাথে মেলে ? লীলাপ্রসঙ্গ থেকেই দেখে নেওয়া যাক | নিম্নে উদ্ধৃত হল 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ' কি বলছেন এ বিষয়ে |

------------------------------------------------------------------------------


শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ

দ্বিতীয় খণ্ড - ষোড়শ অধ্যায়: বেদান্তসাধনের শেষ কথা ও ইসলামধর্মসাধন

------------------------------------------------------------------------------


অদ্বৈতবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত ঠাকুরের মনের উদারতা সম্বন্ধে দৃষ্টান্ত - তাঁহার ইসলাম ধর্মসাধন

---------------------------------------------------------‐------------------


অদ্বৈতবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হইয়া ঠাকুরের মন এখন কিরূপ উদারভাবসম্পন্ন হইয়াছিল, তাহা আমরা এই কালের একটি ঘটনায় স্পষ্ট বুঝিতে পারি। আমরা দেখিয়াছি, ঐ ভাবসাধনে সিদ্ধ হইবার পরে ঠাকুরের শরীর কয়েক মাসের জন্য রোগাক্রান্ত হইয়াছিল। সেই ব্যাধির হস্ত হইতে মুক্ত হইবার পরে উল্লিখিত ঘটনা উপস্থিত হইয়াছিল।


গোবিন্দ রায় নামক এক ব্যক্তি এই সময়ের কিছুকাল পূর্ব হইতে ধর্মান্বেষণে প্রবৃত্ত হন। হৃদয় বলিত, ইনি জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন। সম্ভবতঃ পারসী ও আরবী ভাষায় ইঁহার ব্যুৎপত্তি ছিল। ধর্মসম্বন্ধীয় নানা মতামত আলোচনা করিয়া এবং নানা সম্প্রদায়ের সহিত মিলিত হইয়া ইনি পরিশেষে ইসলামধর্মের উদার মতে আকৃষ্ট হইয়া যথারীতি দীক্ষাগ্রহণ করেন। ধর্মপিপাসু গোবিন্দ ইসলামধর্মমত গ্রহণ করিলেও উহার সামাজিক নিয়মপদ্ধতি কতদূর অনুসরণ করিতেন, বলিতে পারি না। কিন্তু দীক্ষাগ্রহণ করিয়া অবধি তিনি যে কোরানপাঠ এবং তদুক্ত প্রণালীতে সাধনভজনে মহোৎসাহে নিযুক্ত ছিলেন, একথা আমরা শ্রবণ করিয়াছি। গোবিন্দ প্রেমিক ছিলেন। বোধ হয়, ইসলামের সুফী সম্প্রদায়ের প্রচলিত শিক্ষা এবং ভাবসহায়ে ঈশ্বরের উপাসনা করিবার পদ্ধতি তাঁহার হৃদয় অধিকার করিয়াছিল। কারণ ঐ সম্প্রদায়ের দরবেশদিগের মতো তিনি এখন ভাবসাধনে অহোরাত্র নিযুক্ত থাকিতেন।


সুফি গোবিন্দ রায়ের আগমন

------------------------‐-------‐-‐-‐--


যেরূপেই হউক, গোবিন্দ এখন দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে উপস্থিত হয়েন এবং সাধনানুকূল স্থান বুঝিয়া পঞ্চবটীর শান্তিপ্রদ ছায়ায় আসন বিস্তীর্ণ করিয়া কিছুকাল কাটাইতে থাকেন। রানী রাসমণির কালীবাটীতে তখন হিন্দু সংসারত্যাগীদের ন্যায় মুসলমান ফকিরগণেরও সমাদর ছিল এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের ত্যাগী ব্যক্তিদিগের প্রতি এখানে সমভাবে আতিথ্য প্রদর্শন করা হইত। অতএব এখানে থাকিবার কালে গোবিন্দের অন্যত্র ভিক্ষাটনাদি করিতে হইত না এবং ইষ্টচিন্তায় নিযুক্ত হইয়া তিনি সানন্দে দিনযাপন করিতেন।


গোবিন্দের সহিত আলাপ করিয়া ঠাকুরের সঙ্কল্প

----------------------------------------------------------------


প্রেমিক গোবিন্দকে দেখিয়া ঠাকুর তৎপ্রতি আকৃষ্ট হয়েন এবং তাঁহার সহিত আলাপে প্রবৃত্ত হইয়া তাঁহার সরল বিশ্বাস ও প্রেমে মুগ্ধ হয়েন। ঐরূপে ঠাকুরের মন এখন ইসলামধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তিনি ভাবিতে থাকেন, 'ইহাও তো ঈশ্বরলাভের এক পথ, অনন্ত-লীলাময়ী মা এপথ দিয়াও তো কত লোককে তাঁহার শ্রীপাদপদ্মলাভে ধন্য করিতেছেন; কিরূপে তিনি এই পথ দিয়া তাঁহার আশ্রিতদিগকে কৃতার্থ করেন, তাহা দেখিতে হইবে; গোবিন্দের নিকট দীক্ষিত হইয়া এ ভাবসাধনে নিযুক্ত হইব।'


গোবিন্দের নিকট হইতে দীক্ষাগ্রহণ করিয়া সাধনে ঠাকুরের সিদ্ধিলাভ

----------------------‐-------------------------------------------------------


যে চিন্তা, সেই কাজ। ঠাকুর গোবিন্দকে নিজ অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন এবং দীক্ষাগ্রহণ করিয়া যথাবিধি ইসলামধর্মসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। ঠাকুর বলিতেন, "ঐ সময়ে 'আল্লা'-মন্ত্র জপ করিতাম, মুসলমানদিগের ন্যায় কাছা খুলিয়া কাপড় পরিতাম; ত্রিসন্ধ্যা নমাজ পড়িতাম এবং হিন্দুভাব মন হইতে এককালে লুপ্ত হওয়ায় হিন্দু দেবদেবীকে প্রণাম দূরে থাকুক, দর্শন পর্যন্ত করিতে প্রবৃত্তি হইত না। ঐভাবে তিন দিবস অতিবাহিত হইবার পরে ঐ মতের সাধনফল সম্যক হস্তগত হইয়াছিল।" ইসলামধর্মসাধনকালে ঠাকুর প্রথমে এক দীর্ঘশ্মশ্রুবিশিষ্ট, সুগম্ভীর, জ্যোতির্ময় পুরুষপ্রবরের দিব্যদর্শন লাভ করিয়াছিলেন। পরে সগুণ বিরাট ব্রহ্মের উপলব্ধিপূর্বক তুরীয় নির্গুণ ব্রহ্মে তাঁহার মন লীন হইয়া গিয়াছিল।


মুসলমানধর্মসাধনকালে ঠাকুরের আচরণ

--------------------------------------------------------


হৃদয় বলিত, মুসলমানধর্মসাধনের সময় ঠাকুর মুসলমানদিগের প্রিয় খাদ্যসকল, এমন কি গো-মাংস পর্যন্ত গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক হইয়াছিলেন। মথুরামোহনের সানুনয় অনুরোধই তখন তাঁহাকে ঐ কর্ম হইতে নিরস্ত করিয়াছিল। বালকস্বভাব ঠাকুরের ঐরূপ ইচ্ছা অন্ততঃ আংশিক পূর্ণ না হইলে তিনি কখনও নিরস্ত হইবেন না ভাবিয়া মথুর ঐ সময়ে এক মুসলমান পাচক আনাইয়া তাহার নির্দেশে এক ব্রাহ্মণের দ্বারা মুসলমানদিগের প্রণালীতে খাদ্যসকল রন্ধন করাইয়া ঠাকুরকে খাইতে দিয়াছিলেন। মুসলমানধর্মসাধনের সময় ঠাকুর কালীবাটীর অভ্যন্তরে একবারও পদার্পণ করেন নাই। উহার বাহিরে অবস্থিত মথুরামোহনের কুঠিতেই বাস করিয়াছিলেন।


ভারতে হিন্দু ও মুসলমান জাতি কালে ভ্রাতৃভাবে মিলিত হইবে, ঠাকুরের ইসলামমত-সাধনে ঐ বিষয় বুঝা যায়

--------------------------------------------------------------------------


বেদান্তসাধনে সিদ্ধ হইয়া ঠাকুরের মন অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি কিরূপ সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়াছিল, তাহা পূর্বোক্ত ঘটনায় বুঝিতে পারা যায় এবং একমাত্র বেদান্তবিজ্ঞানে বিশ্বাসী হইয়াই যে ভারতের হিন্দু ও মুসলমানকুল পরস্পর সহানুভূতিসম্পন্ন এবং ভ্রাতৃভাবে নিবদ্ধ হইতে পারে, একথাও হৃদয়ঙ্গম হয়। নতুবা ঠাকুর যেমন বলিতেন, "হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যেন একটা পর্বত-ব্যবধান রহিয়াছে - পরস্পরের চিন্তাপ্রণালী, ধর্মবিশ্বাস ও কার্যকলাপ এতকাল একত্রবাসেও পরস্পরের নিকট সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য হইয়া রহিয়াছে।" ঐ পাহাড় যে একদিন অন্তর্হিত হইবে এবং উভয়ে প্রেমে পরস্পরকে আলিঙ্গন করিবে, যুগাবতার ঠাকুরের মুসলমানধর্মসাধন কি তাহারই সূচনা করিয়া যাইল?

------------------------------------------------------------------------------


তৃতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)


যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ৪

-------------------------------------------------------------------------


শ্রীরামকৃষ্ণ ও তৎপূর্ববর্তী ভারতীয় মুনিঋষিরা সনাতন ধর্মের যে উচ্চ আধ্যাত্মিক আদর্শ জগতে স্থাপন করেছেন তা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যযুগের ধর্মমতগুলির মধ্যে পাওয়া যায় না | এব্রাহ্যাম সূচিত জুডীয়ধর্ম (Judaism), যীষুখ্রীষ্ঠ প্রবর্তিত খ্রীষ্ঠধর্ম (Christianity) ও মুহম্মদ প্রচারিত ইসলামধর্ম (Islam) -- এই তিনটি ধর্মেই ব্রহ্মজ্ঞান, আত্মজ্ঞান, মোক্ষ, মুক্তি, নির্বাণ, অনাহত ওঁঙ্কারধ্বনি, কর্মবাদ, পুনর্জন্ম, ষড়চক্র, সপ্তভূমি, কুলকুণ্ডলিনীশক্তি ইত্যাদি তত্ত্বের কোনও উল্লেখ নেই | মধ্যপ্রাচ্যের এই তিনটি ধর্মকে সেমিটিক ধর্ম (Semitic Religions) ও এব্রাহ্যামিক ধর্ম (Abrahamic Religions) বলা হয় | বর্তমান আলোচনা সীমিত রাখব শুধু ইসলামধর্মের মধ্যে |


শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলামধর্ম সাধন করে সিদ্ধিলাভ করলেন | সে সিদ্ধি মাত্র তিন দিনে সিদ্ধ হল কারণ তাঁর ক্ষেত্র ছিল অধ্যাত্মসিদ্ধির জন্য প্রস্তুত | অদ্বৈতজ্ঞানলাভের পর দ্বৈতভূমিতে নেমে এসে এ সাধনা | তাই আন্তরিক হলেও, অনায়াস | কিন্তু কি সেই সিদ্ধির উপলব্ধি ?


'ইসলামধর্মসাধনকালে ঠাকুর প্রথমে এক দীর্ঘশ্মশ্রুবিশিষ্ট, সুগম্ভীর, জ্যোতির্ময় পুরুষপ্রবরের দিব্যদর্শন লাভ করিয়াছিলেন। পরে সগুণ বিরাট ব্রহ্মের উপলব্ধিপূর্বক তুরীয় নির্গুণ ব্রহ্মে তাঁহার মন লীন হইয়া গিয়াছিল।' -- [ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ ]


কুরানে বর্ণিত আল্লার সাথে কি সনাতন ধর্মের সগুণ তথা নির্গুণ ব্রহ্মের কোনও সাদৃশ্য আছে ? হিন্দু তাঁর বদান্যতাহেতু সাদৃশ্য খোঁজেন কিন্তু মুসলমান তা মানেন না | অতএব, বহিরাঙ্গ দৃষ্টি দিয়ে দেখলে বলা যেতে পারে যে শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলামধর্ম সাধন করে যে আধ্যাত্মিক অনুভূতিস্বরূপ ফললাভ করলেন তা সনাতন ধর্মেরই দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈতবাদের অনুভূতি | শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মবুদ্ধি অবৈদিক ধর্মমতগুলির মধ্যেও সনাতন ধর্মের সত্যকেই পেয়েছিল যা আদপে ওসব অবৈদিক ধর্মের আকর গ্রন্থের অন্তর্গত তত্ত্বের সাথে মেলে না |


শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতার চিড়িয়াখানায় সিংহ দেখে তাঁর দেবীদূর্গার বাহনের কথা স্মরণ হওয়ায় দেবীর ভাবে সমাধিস্থ হন | একই ভাবে ময়দানে ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান ইংরেজ কিশোরকে দেখে ত্রিভঙ্গমুরারি শ্রীকৃষ্ণের স্মরণে তিনি সমাধিস্থ হন | এরকম অজস্র অবস্থায় তিনি সমাধিস্থ হন জীবনে | সমাধিস্থ হওয়া তাঁর কাছে ছিল নিশ্বাসপ্রশ্বাসের ন্যায় সহজসিদ্ধ | উপরোক্ত দুই ঘটনার উদাহরণ থেকে কি আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হব তাহলে যে শ্রীরামকৃষ্ণ 'সিংহধর্ম' ও 'ইংরেজধর্ম' পালন করেছিলেন ও ঐ দুই ধর্মে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধিলাভ করে তার যাথার্থ প্রমাণ করেছিলেন ? নাকি আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হব যে ভাবমুখে অবস্থিত শ্রীরামকৃষ্ণ যে কোনও বস্তু হতেই উদ্দীপিত হয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ সনাতন ধর্মবোধেই ফিরে গেছেন ও সনাতন ধর্মের যাথার্থেরই প্রমাণ রেখেছেন তাঁর সর্ব অনুভূতি ও উপলব্ধির দ্বারা ?


অর্থাৎ, শ্রীরামকৃষ্ণের একটি সুফী সম্প্রদায়ের সাধনপ্রণালী অবলম্বন করে সাধনা ও সিদ্ধিলাভ কি আদি ও অপরিবর্তিত কুরানভিত্তিক ইসলামের তত্ত্বগত অথবা ব্যবহারগত যাথার্থ কোনোভাবে প্রমাণ করে ? মৃত্যুর পর না তিনি কোনও কবরে গোর হলেন না কোনও আল্লা তাঁর পার্থিবকর্মের বিচার করবেন ও সৎকর্মের জন্য জন্নতে ভোগসুখ সম্পাদন করার জন্য স্থান দেবেন বলে আশা করতেন তিনি যিনি ছিলেন নির্বাসনার মূর্ত বিগ্রহ | কলমা পড়ে যদি বা আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলামধর্ম কবুল করেও থাকেন তো তা মোটে তিন দিনের সাধনকালের জন্য ব্যবহারগত অপরিহার্যতাহেতু কিন্তু চতুর্থ দিন হতেই আবার ইসলামে হারাম সেই দেবীবিগ্রহের আরাধনা করেছেন | অর্থাৎ, তিনি ইসলামধর্ম পরিত্যাগ করলেন মাত্র তিনটি দিন তার অধীনে থাকার পরই | যদি কুরানকথিত ইসলাম তত্ত্ব তিনি একান্তই মানতেন চূড়ান্ত সত্য বলে তাহলে তাকে পরিহার করতে পারতেন কি তিনি ? কারণ শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন একান্ত সত্যনিষ্ঠ | তিনি কখনই সত্যকে পরিহার করতে পারতেন না | কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তা ত্যাগের মাধ্যমে তিনি তা অবলীলায় পারলেন | এর থেকে কি প্রমাণ হয় ? ইসলামের দ্বৈতবুদ্ধির আপেক্ষিক সত্যতা ঐ ধর্ম সাধনকালে সাধনার ব্যবহারিক আবশ্যকতাহেতু পূর্ণমনে স্বীকার করে নিলেও শ্রীরামকৃষ্ণ সনাতন ধর্মকেই সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন যা তাঁর উক্ত এই বাণীটিতেই পূর্ণ প্রকাশিত -- "আধুনিক ধর্ম সব আসবে যাবে, এক সনাতন ধর্ম থাকবে | তবে একেবারে যাবে না, ঐ একটু আধটু থাকবে |"


চতুর্থ অধ্যায়ের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)


যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ৫

-------------------------------------------------------------------------


পবিত্রজন কাপুরুষ হন না | কাপুরুষ পবিত্র হন না | এটি এক স্বতঃসিদ্ধ সত্য | ভক্তির আড়ালে ভয় থাকলে ঠাকুরের ভক্ত হওয়া যায় না কারণ তিনি বলেছেন, "লজ্জা, ঘৃণা, ভয় -- এ তিন থাকতে নয় |" সত্যস্বরূপ ঠাকুর নির্ভীক নরেন্দ্রকে তাই তাঁর বার্তাবহরূপে এনেছিলেন কারণ তিনি জানতেন জগতে সনাতন সত্য প্রচার ও লোকমানসে তা প্রতিষ্ঠা করতে একমাত্র অকুতোভয়, সত্যনিষ্ঠ, জিতেন্দ্রিয় পুরুষই পারেন | এ কর্ম ভীরু কাপুরুষের নয়, প্রতিষ্ঠিত মিথ্যার সাথে আপোসকারীর নয় |


সাধুজনের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতীর বিনাশ ও ধর্মসংস্থাপনের জন্য অবতারের আবির্ভাব ঘটে | এ সহজসাধ্য মিশন নয় যে সাধারণ মানুষে সংসাধন করবেন | এ যুগপরিবর্তনের মহাযজ্ঞ | তাই মহাশক্তির প্রকাশ দিব্য অবতরণে | সত্য ও শক্তি -- এই দুইয়ের যুগ্ম অবস্থান অবতার-আধারে | রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সেই যুগ্মগুণের যৌথপ্রকাশ | শ্রীরামকৃষ্ণকে যদি দেবমানবদেহে সত্যের প্রতিভূ বলা যায়, তো স্বামী বিবেকানন্দকে মহাশক্তির বিকিরণকেন্দ্র বলা চলে |


অতএব, সত্য ও শক্তি -- এই দুটি হল মুখ্য উপাদান অবতারলীলায় ; সত্যপ্রতিষ্ঠা শক্তিসহায়ে | কিন্তু ইতিহাস তো বিবর্তনসাপেক্ষ, ইচ্ছামত গড়া যায় না | তাই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে কর্ম করতে হয় | এইখানেই এসে পড়ে আপোস | আর যদি মনুষ্যসমাজের অবস্থান্তর ঘটাতে খোদ অবতারকেই পরিস্থিতির সাথে কতকটা মানিয়ে কর্মসম্পাদন করতে হয় তো তৎপরবর্তি তাঁর অনুগামীদের কা কথা ? তাঁরা কেমন করে জগতের এই জতুগৃহে অকপট সত্যভাষণ করবেন যেখানে সামান্যতম বাকস্ফুলিঙ্গে মুহূর্তমাত্রে দাবানল জ্বলে উঠতে পারে সমাজের বুকে ? কেমন করে তাঁরা বর্বর সমাজে সেই বর্বরতার আদি কারণ জ্ঞাপন করবেন সর্বসমক্ষে ভীষণ অগ্নিসংযোগ না করে ? যে বর্বরতা তলোয়ারের আগায় প্রচারিত হয়েছিল অগণিত মানুৃষের শোণিতস্নানে শত শত বর্ষ ধরে, যা তাঁদের ধমনীতে আজ বহমান নিত্যস্মৃত অসহিষ্ণু, হিংসাত্মক ভাবরূপে, কেমন করে তার বজ্রবাহুর পেষণ হতে মানুষকে নিষ্কাশিত করবেন অবতারের অনুগামীরা স্বল্পসত্যের মৃদুসম্ভাষণের দ্বারা ?


অপশক্তির মোকাবিলা তো শুভশক্তির বলিষ্ঠ প্রয়োগই পারে করতে, মৃদুভাষণের তো তা কর্ম নয় | সুতরাং, জগতের জটিল পরিস্থিতিতে যেমন যথেচ্ছ বাক্যপ্রয়োগের দ্বারা সংঘাত বাড়বে বই কমবে না, তেমনই সত্যগোপনের দ্বারাও সমস্যার সমাধান হবে না | উপায় সুখপ্রদ মধ্যপন্থা অবলম্বনও নয় | উপায় সত্যজ্ঞাপন প্রিয় করে, মিথ্যার শুভ্রবস্ত্রে বর্বরতার কলুষকে আবৃত করার প্রচেষ্টায় নয় | উপায় বর্বরতার সত্যকে ধীর পদক্ষেপে অনাবৃত করা ঐতিহাসিক সত্য বিবরণের মধ্য দিয়ে | উপায় বর্বর তত্ত্বের আকর গ্রন্থপাঠ, তার সম্বন্ধে সম্যক পরিচিতি ও তার সুশিক্ষিত, রুচিসম্পন্ন, মার্জিত প্রচার গণমাধ্যমে সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে | আর সর্বোপরি উপায় এই মিথ্যাভাষণ বন্ধ করা যে ও তত্ত্ব বর্বরতা তো নয়, ও দিব্যপুরুষের দিব্যপ্রেমের দিব্যতত্ত্ব মানুষের উদ্ধারকল্পে | বৈরীভাবাপন্ন সম্প্রদায়ের সাথে যথার্থ সম্প্রীতি বেদান্তসত্যের যথার্থ ভিত্তিভূমির ওপরই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কালক্রমে, তাঁদের ধর্মান্ধতাকে ভ্রাতৃত্বের নাম দিয়ে নয় | মিথ্যার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী এবং তাই ঘটছে তাঁদের সাথে যাঁরা বর্বরতাকে ঢাকছেন অনৃতভাষণের দ্বারা | তাই হিন্দুর আজ এই হাল, এই চূড়ান্ত বিপর্যয় মুসলমানের হাতে পদে পদে যেখানেই সে সংখ্যালঘু |


পঞ্চম অধ্যায়ের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)


যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন ... ৬

-------------------------------------------------------------------------


শ্রীরামকৃষ্ণের ইসলামধর্মসাধনা ও সিদ্ধি, ও তার নামাঙ্কিত মিশন দ্বারা তাঁর সাধনা ও সিদ্ধির ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে কিছু বিতর্ক প্রায়ই ধ্বনিত হয় যার আলোচনা এই রচনাপ্রবাহে একান্ত আবশ্যক |


প্রথমতঃ, আদপে কি শ্রীরামকৃষ্ণ কলমা (কলিমহ্) পড়ে প্রথাগতভাবে ইসলামধর্ম কবুল করেছিলেন তাঁর সুফী গুরু গোবিন্দ রায়ের কাছে ? গোবিন্দ রায় কি নিজেও তাঁর জন্মসূত্রে লব্ধ হিন্দুধর্ম পরিত্যাগপূর্বক কলমা (কলিমহ্) পড়ে প্রথাগতভাবে ইসলামধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ? তাঁর ইসলামী নাম কি? শ্রীরামকৃষ্ণ কি এই ব্যাপারে অবগত ছিলেন যে ইসলাম গ্রহণ করা যায় কলমা (কলিমহ্) পড়ে ঠিকই কিন্তু ইসলাম ত্যাগ করা যায় না কোনও মতে কারণ তা আল্লাহ্'র বিচারে গর্হিত অপরাধ এবং শরিয়ত আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডনীয় অপরাধ ? অর্থাৎ, ইসলামধর্মে দীক্ষাগ্রহণকালে তিনি কি একথা জানতেন যে তিনি এক করাল কারাগারে স্বেচ্ছায় প্রবেশ করতে চলেছেন যার প্রবেশপথ অবশ্যই প্রশস্ত কিন্তু বহির্গমনের কোনও পথ নেই ? ফলতঃ তাঁকে চিরকাল মুসলমানই থাকতে হবে ঐ ধর্মের বিধান অনুযায়ী ? আর যদি তিনি তা না মেনে পুনরায় পৌত্তলিক হিন্দুধর্মে প্রত্যাবর্তন করেন, তাহলে তিনি মুশরিক আখ্যাপ্রাপ্ত হবেন ও ইসলামত্যাগের অপরাধে জিহাদিহস্তে বধযোগ্য হবেন ? সর্বোপরি, শ্রীরামকৃষ্ণ কি জানতেন যে কলমা (কলিমহ্) পড়ে ইসলামগ্রহণের পর তিনি যদি তা পুনরায় ত্যাগ করেন তো তা ইসলামের প্রতি, রসুলের প্রতি ও আল্লাহ'র প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হবে ও সত্যের অপলাপ হবে এক অর্থে ? সত্যপরায়ণ, সত্যভাষী, সত্যসঙ্কল্প শ্রীশ্রীঠাকুর কি সাধনশেষে সত্যভঙ্গের এই সম্ভাবনার কথা ভাববার অবকাশ পেয়েছিলেন, অর্থাৎ, গোবিন্দ রায় কি তাঁকে এই সম্ভাবনা সম্বন্ধে সূচিত করেছিলেন ?


দ্বিতীয়তঃ, সুফীধর্ম কি কুরান ও হদীস স্বীকৃত আদি ইসলামেরই এক শাখা নাকি তা ইসলামের বেদান্তপ্রভাবিত এক বিবর্তিত, পরিবর্তিত রূপ যা আদি ইসলামধর্ম হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন, অর্থাৎ, কিয়ৎ আপাতসাদৃশ্যসত্তেও আদত ইসলামই নয় ? 


তৃতীয়তঃ, শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবগত ছিলেন ইসলামের ভয়ানক বিগ্রহবিদ্বেষ সম্বন্ধে যার ব্যবহারিক পরিণতি ভারতে সহস্রবৎসর হিন্দুনির্যাতন ? গোবিন্দ রায় কি তাঁকে কুরানের কাফিরসংক্রান্ত আয়াতসমূহ এবং হদীস ও সীরাহ্'র অনুরূপ বিদ্বেষপূর্ণ সূত্র ও কাহিনীগুলি শুনিয়েছিলেন ? নাকি বেছে বেছে মক্কাপর্বের কিছু অপেক্ষাকৃত অহিংস আয়াত শুনিয়ে মদীনাপর্বের ভয়ঙ্কর সব আয়াতগুলির সম্যকজ্ঞান হতে শ্রীরামকৃষ্ণকে বঞ্চিত রেখেছিলেন যার ফলে ইসলামের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক স্বরূপ সম্বন্ধে তিনি অবগত হওয়ার সুযোগ পাননি ? ইসলামের প্রবক্তা পয়গম্বর মুহম্মদের হদীসনির্দেশিত সুন্নাহ্ ও সীরাহ্'বর্ণিত তাঁর জীবনকাহিনীই বা কতটুকু জানানো হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণকে, বিশেষতঃ যখন গোবিন্দ রায় বহুপরিমার্জিত, বেদান্তসদৃশ, উন্নত সুফীধর্ম তাঁর শিষ্যকে শিক্ষা দিচ্ছিলেন, তাও আবার পুঁথিগতভাবে নয়, ফলিত সাধনসহায়ে ?


ষষ্ঠভাগের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)


যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন  ... ৭

-------------------------------------------------------------------------


রামকৃষ্ণ মিশন সর্বধর্মসমন্বয়ের বাণী প্রচার করছেন বটে কিন্তু তা মুসলমান ও খ্রীষ্ঠানের বোধগম্য হচ্ছে না | পাকিস্তান, সৌদি আরব ও ভ্যাটিকান সিটিতে রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা কেন্দ্র খোলা তাই এই মুহূর্তে একান্ত আবশ্যক | এটিই হবে যুগাবতারের অনুগামীদের যথার্থ যুগধর্মপালনে অন্যতম পদক্ষেপগ্রহণ |


হিন্দুকে ধরে ধরে শুধু সর্বধর্মসমন্বয়ের বাণী বারংবার শোনানো তো অনেক হল | কিন্তু সর্বধর্মের অনুগামীরা তা তো মোটেই গ্রহণ করলেন না | খ্রীষ্ঠধর্মাবলম্বী ও ইসলামপন্থী মুষ্টিমেয় মানুষ এই সুমহান বার্তা শুনলেন ও একরকম গরগ্রহণ করলেন কারণ তাঁরা একদিকে যেমন কেউই উচ্চকন্ঠে এ কথা বললেন না যে শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বমতকে স্বীকৃতিদান খ্রীষ্ঠধর্ম ও ইসলামবিরোধী এবং বাইবেল ও কুর'আনের শিক্ষা অনুযায়ী বর্জনীয়, তেমনি এও বললেন না যে স্বধর্মের তত্ত্বকে ও স্বশাস্ত্রের অনুশাসনকে সংকীর্ণ ও ভ্রান্তজ্ঞানে তাঁরা বর্জন করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের বিশ্বজনীন সনাতন ধর্মোপলব্ধির আলোকে | অর্থাৎ, যদিও রামকৃষ্ণ মিশন এ কথা বলে থাকেন যে তাঁদের সাধু ও ভক্তশিষ্যদের মধ্যে সকল ধর্মের অনুগামীই আছেন, তবুও তাঁদের তথাকথিত মুসলমান সাধু ও ভক্তশিষ্যদের মুখে কিন্তু এ কথা শোনা যায় না যে তাঁরা তাঁদের নবীর নির্দেশ ও আল্লাহ'র আদেশ আর মানেন না | তাঁরা তাহলে দ্বিচারিতা করছেন ধর্মপালন নিয়ে যা ধার্মিক হওয়ার মোটেই লক্ষণ নয় |


যাই হক | কথা বাঁক নেবার আগে মূল ধারায় ফেরা যাক | দেশবিভাগের অব্যবহিত পরেই করাচি রামকৃষ্ণ মিশন শাখায় বৎসরকাল ধরে ইসলামী হামলা চলতে থাকে যার ফলে ভারপ্রাপ্ত মহন্ত স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী করাচির পাঠ চুকিয়ে বিভাজিত ভারতভূখণ্ডে ফিরে আসেন | পাকিস্তানের প্রচারপালা এখানেই শেষ হয়ে যায় | নবী মুহম্মদের গাজ়ওয়া-এ-হিন্দের ১২৪০ বর্ষব্যাপী (৭০৭ -- ১৯৪৭) ভারতে জিহাদের আর একটি জয় হয়, এবার শান্তিময় সর্বধর্মসমন্বয়ের কুফ্রি ভাবান্দোলনের বিরুদ্ধে |


১৯০০ খ্রীষ্ঠাব্দে আমেরিকার সান্ ফ্রানসিস্কো শহরে স্বামীজী বলেছিলেন যে উদার মতবাদের বার বার পরাজয় হয় ধর্মান্ধতার হস্তে | তাই হল | রঙ্গনাথানন্দজীর করাচিতে বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল | তিনি করাচির বিদ্বৎমহলে বিশেষ সমাদৃত ছিলেম ধর্মীয়, দার্শনিক ও সমাজবিষয়ক বক্তারূপে, অত্যন্ত শ্রদ্ধার্হ ছিলেন গুণীজনের, মানবদরদীরূপে প্রিয়পাত্র ছিলেন সহস্র সাধারণের কাছে | কিন্তু সময়কালে এ সব কোন কাজেই লাগল না | অকস্মাৎ কুর-আন, হাদীস ও সিরাহ্ প্রদর্শিত ইসলামের আদি পথ, আদি তত্ত্ব, আল্লাহ'র কাফিরহননের অমোঘ নির্দেশ রাজনৈতিক কলহের কোলাহলমাঝে মুখ্য হয়ে উঠল এবং রামকৃষ্ণ মিশনের বিদায় হল করাচি থেকে | ইসলামের জয় হল, ঠিক যেমনটি কুর-আনে নির্দিষ্ট আছে, তেমনই |


সপ্তম ভাগের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)


যত মত, তত পথ -- বিতর্কের মুখে রামকৃষ্ণ মিশন  ... ৮

--------------------------------------------------------------------------


খাদ্য ও খাদক -- এই দুইয়ের সমন্বয় কি সম্ভব ? ব্যবহারিক স্তর থেকে দেখতে হবে, আদর্শের অলীক কল্পনাসহায়ে নয় | এ কথা বললে হবে না যে বেদান্তে সব সমন্বয় হয়েছে | হয়েছে নাকি ? তাহলে আইন সাজা দেন কেন আততায়ীকে ? বেদান্তবুদ্ধিতে সমন্বয় করে নিয়ে ক্ষমা করলেই পারেন ? পারেন কিনা ? বেদান্তে সমন্বয় হয়ছে যা ভাবজগতে, বাস্তবে তা আদপেই হয়নি, হবেও না, যেমন নাৎসী হিংসাতত্ত্ব ও জৈন অহিংসতত্ত্বের সমন্বয় অবাস্তব, অসম্ভব, সরাসরি মিথ্যাচার |


শ্রীরামকৃষ্ণ অতি উচ্চকোটির মানুষ, তাই অবতার | তিনি দেবমানব, তাই অভ্রান্ত নন | তাঁকে যা বোঝানো হয়েছে, তাই বুঝেছেন সরল বুদ্ধিতে | গোবিন্দ রায় কি সবটুকু বলেছিলেন তাঁর দিব্য শিষ্যকে, ইসলামের পুর্ণ তত্ত্ব, সম্পূর্ণ ইতিহাস ? কুরান, হাদিস ও সিরাহ্ -- এই শাস্ত্রত্রয়ীর সার কথাটিও বলেছিলেন কি ? না, আমার ধারণা বলেন নি কারণ বলার কোনও প্রয়োজন বোধ করেন নি সম্ভবতঃ | তাঁর ছিল সুফীসাধন শিক্ষা দেওয়া কাজ তাঁর অধ্যাত্মপিপাসু শিষ্যকে, ইসলামের সঠিক জ্ঞানদান নয় | তাই ভবিষ্যৎধারণার গোড়াতেই গলদ রয়ে গেল এখানেই | ঠিক জ্ঞানের অভাব | কেন এমন হল তা ইতিহাসসাপেক্ষ পর্যালোচনার বিষয় |


গোবিন্দ রায় প্রেমিক সুফী | ইসলামের সঠিক অনুগামী নন নিজেই | কারণ সুফী সম্প্রদায়ের মত ঠিক ঠিক কুরানে ব্যক্ত আল্লাহ্'র বাণীর অনুগামী নয় | ভারতবর্ষে পালিত কোনও কোনও সুফী মত বেদান্তেরই ছায়া, আদি ও অপরিবর্তনশীল, আল্লাহ্'নির্দেশিত কুরানের অভ্রান্ত বাণীর অনুগামী নয় | তাই শ্রীশ্রীঠাকুরের সাধনসমাপনে ভ্রান্ত ধারণা হল যে তিনি ইসলামসাধন করলেন ও সিদ্ধিলাভ করলেন সেই মত অনুযায়ী যেমনটি তাঁকে বলা হয়েছিল |


নামাজ পড়লেই, আলখাল্লা পরলেই, পেঁয়াজরসুনসহযোগে অন্নব্যঞ্জনমৎসমাংসাদি আহার করলেই কিছু ইসলামপালন, ইসলামসাধন হয় না | ইসলামের ইমানটি ধারণ করা চাই আজীবন চিত্তে যা হল এক আল্লাহ্ই সর্বোচ্চ সত্য ও তাঁর রসুলই শেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর | ঠাকুর ইমানটি কি আজীবন, এমনকি মুহূর্তমাত্রও সঠিকভাবে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বুঝে পালন করেছিলেন ? না, তা করেন নি তিনি, তা তাঁর ইসলামসাধনপরবর্তি বিগ্রহপূজা, কালীভক্তি ও সর্বধর্মসমন্বয়বাদীই প্রমাণ করছে, তাঁর মুহূর্মুহু ব্রহ্মসমাধিই প্রমাণ করছে কারণ ইসলামে না আছে মূর্তিপূজা, না আছে দ্বন্দাতীত, অদ্বৈত ব্রহ্মবাদ, না আর কোনও ধর্মকে সঠিক পথ বলে স্বীকৃতিদান |


ঠাকুরের পুনরায় হিন্দুধর্মপালন প্রমাণিত করে তাঁর ইসলামের মূলনীতিতে অনাস্থা | এমনকি তাঁর ইসলামে সিদ্ধিলাভও ইসলামবিরোধী অনুভূতি কারণ না ইসলামে ব্রহ্মজ্ঞানে উপনীত হওয়ার কোনও তত্ত্বগত অনুমোদন আছে না তাতে কোনও ফেরেস্তার দর্শন সিদ্ধলাভের লক্ষ্য বলে পরিগণিত | ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য জন্নতলাভ, গাজ়ওয়ায়ে হিন্দের পর, কায়ামতের পরবর্তিকালে যখন আখীরিয়তের (শেষ) বিচার হবে | ঠাকুর কি তাহলে সাধন করেছিলেন জন্নতে যাবেন বলে ? সাধুরা কি বলেন এ বিষয়ে ?


অতএব, এই 'যত মত, তত পথ' কথাটি ঠাকুর বেদান্তের 'একম্ সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি' অর্থে বলেছিলেন, এমনটিই বলা চলে | এর দ্বারা ইসলাম একটি ব্রহ্মলাভের পথ, এমনটি বলা যায় না কারণ কুরান, হাদিস ও সিরাহ্, ইসলামের শাস্ত্রত্রয়ীর পরিপন্থী তা |


এখন বাস্তবে ফেরা যাক | শ্রীরামকৃষ্ণ তো কিছু আল্লাহ্ ও মুহম্মদের দাস নন যে তিনি যা বলবেন উপলব্ধির স্তর হতে তা তাঁদের মতানুযায়ী হতে হবে | তিনি স্বাধীন সত্তা | যেমন দর্শন করেছেন, তেমনই বলেছেন | সুফীধর্ম পালন করতে গিয়ে পড়লেন ব্রহ্মসমুদ্রে | তা তিনি করবেন কি ? বলবেন, না তেমন কোনও অনুভূতি হয়নি ? প্রশ্নটি তাঁর উপলব্ধি নিয়ে নয়, তার বাস্তব সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ও পরিণতি নিয়ে |


শ্রীরামকৃষ্ণ হয়ত এমন এক ধর্ম দিয়ে গেলেন যা ভবিষ্যতের মুসলমান সমাজ পালন করবেন যখন তাঁরা বুঝতে পারবেন যে তাঁদের ঐতিহাসিক ধর্মটি আধুনিক যুগে অচল হয়ে পড়েছে | তখন এই বিপুল ইসলামপন্থী জনসংখ্যা যাবেন কোথায় ? কোন্ মত ধারণ করবে তাঁদের ? হয়ত শ্রীরামকৃষ্ণের এই নবইসলামেই আশ্রয় নেবেন তাঁরা, এমনও তো হতে পারে ? প্রশ্ন হল এই যে এই পরিবর্তিত ইসলাম তো ইসলামই নয় কারণ ইসলাম তো স্বয়ংসম্পূর্ণ, নিখুঁত মত, সাক্ষাৎ আল্লাহ্'র বাণী ও আদেশসম্বলিত জীবনের একমাত্র সম্পূর্ণসঠিক জীবনাদর্শ ও পথ | তা তো কোনও পরিবর্তনের অপেক্ষাই রাখে না | তাহলে ?


তাহলে আর কি ? ভুল তত্ত্ব জানা, তথ্য গোপন করা, ভুল সিদ্ধান্তে আসা, ভ্রান্ত প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, হিন্দুদের সত্য আবৃত করে দুর্বল করা ও প্রাকারান্তরে বিধ্বংসী বিধর্মীর হাতে নিধনের ব্যবস্থা করা, দেশভাগ রোধের শক্তিকে একপ্রকার দুর্বল করা সত্যের অপলাপ করে, মানবসংহতির মূল ভিত্তি যে সত্যকে মুখোমুখি দেখা ও মায়াকে সম্মুখরণে আহ্বান করা, সেই কর্মকে উল্টো পথে পরিচালিত করা -- এই সবই হয়েছে এযাবৎ যুগধর্মসংস্থাপনের নামে |


সমাজসেবা এক আর সত্যভাষণ আর এক | প্রথমটি অপূর্ব ত্যাগের দ্বারা পালিত হয়েছে কিন্তু দ্বিতীয়টি অরাজনৈতিকতার আড়ালে, ঐতিহাসিক পরিস্থিতির চাপে কোনওকালেই পালিত হয়নি পূর্ণভাবে | তাই ইসলাম সম্বন্ধে এই বিভ্রান্তি হিন্দু জনমানসে |


সময় এসেছে এ বিভ্রান্তি দূর করার | তথ্যজ্ঞানের আলোয় ইসলাম আজ অনাবৃত, উন্মোচিত পৃথিবীর জনপথে | ইন্টারনেটের সাহায্যে প্রতিটি মানুষ জানার সুযোগ পাচ্ছেন আজ | এরপরও যদি সর্বধর্মসমন্বয়বাদীরা মিথ্যাচার করেন, তো ধরা পড়ে যাবেন | তাই তেমন করবেন না তাঁরা আর যদি হিন্দু সচেতন হন |


অষ্টম ভাগের সমাপ্তি | ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে |


ক্রমশঃ ... 


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment