Sunday 27 June 2021

বন্দে মাতরম ... ১


বন্দে মাতরম ... ১


নেতা হয়ে অন্যেকে ফাঁসিকাঠে ঝোলার অনুপ্রেরণা দেওয়া ঢেড় সহজ কিন্তু নিজে ফাঁসিকাঠে ঝোলার অবস্থা এলে মনোভাব পালটে যায় | তখন ভয়ে 'আধ্যাত্মিক' অনুপ্রেরণা আসে ও পলায়নই শ্রেয় বলে বোধ হয় | এ আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যে নেতা স্বয়ং অনুগামীদের মাতৃভূমির শৃঙ্খলমোচনে বলিদান দিয়ে নিজ শরীরে আঁচটি লাগতে দেননি | অবশ্য সৌভাগ্য এই যে আমরা তাঁর মণীষাকে হারালাম না তাই তাঁর অঘটিত সম্ভাব্য অকালমৃত্যুর মধ্যে যদি তিনি বিপ্লবের পথ না ছেড়ে দেশেই থেকে যেতেন, কারণ তাঁর ভবিষ্যৎ ফাঁসি কিম্বা দীপান্তরের ব্যবস্থা করতে বৃটিশ কোনমতেই নিশ্চেষ্ট থাকতেন না | কিন্তু বিরত্ব ? আদর্শ ? সতীর্থের প্রতি, দেশের প্রতি কর্তব্য ? ভবিষ্যৎ কি চোখে দেখবে এই রণে ভঙ্গ দেওয়া ? রাসবিহারী বসুও তো দেশছাড়া হয়েছিলেন কিন্তু তিনি বিপ্লবছাড়া হননি | তিনি আজীবন বিপ্লব পরিচালনার স্বার্থেই জাপানে কাটিয়েছেন ও পরাধীন দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতালাভের নিমিত্তই কাজ করেছেন | 


যিনি সত্যই ঋষি তিনি কি এতগুলো ছেলেকে এহেন বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে নিজে গা বাঁচান ? ফাঁসি, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু, দীপান্তরের অকথ্য অত্যাচারে আত্মহনন -- এ সবের মধ্যে এতগুলো যুবককে ঠেলে দিয়ে নিজে রণে ভঙ্গ দেওয়া ? এ কেমন ঋষিসুলভ আচরণ ? স্বামীজী হলে কি এ কাজ করতেন ? নেতাজী প্রথমে আশায় ভর করে তাঁর বিপ্লবীরূপের প্রতি মুগ্ধ হলেও পরে আশাহত হন ও তাঁর এই পণ্ডিচেরীতে বসে কংগ্রেসের কার্যকলাপ সম্বন্ধে টিপ্পুনি দেওয়াকে দ্যর্থহীন ভাষায় কটাক্ষ করেন | 


সুভাষচন্দ্র ছিলেন যথার্থ বিপ্লবী | তিনিও আধ্যাত্মিক পথের পথিক ছিলেন কৈশোর থেকে | কিন্তু তিনি ছিলেন সাচ্চা মানুষ স্বামীজীর মত, রাসবিহারী বসুর মত, বাঘা যতীনের মত | তাঁর এ হেন 'আধ্যাত্মিকতার' আড়ালে কাপুরুষোচিত আচরণ ভাল লাগবে কেন ? যে নিবেদিতার পরামর্শে ও তাঁরই প্রদত্ত বৃটিশ গোয়েন্দা বিভাগের পরিকল্পনার সূচনাতে অরবিন্দ ঘোষ চন্দননগর হয়ে পণ্ডিচেরী পলায়ন করেন, সেই নিবেদিতা তো স্বপ্নেও কল্পনা করেননি এই আশু বিপ্লববিমুখতা | তিনি বেঁচে থাকলে কি বলতেন ? অধিমানস ও অতিমানস শক্তির অবতরণ নিয়ে আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসু ও রোঁমা রোঁলা নিজেদের মধ্যে রহস্যালাপ (অর্থাৎ, হাসাহাসি) করেছিলেন এর অবৈজ্ঞানিকতা ও অসম্ভবতা নিয়ে | নিবেদিতা বীরাঙ্গনা ছিলেন যথার্থ | তিনি এই কাপুরুষতা কি চোখে দেখতেন ? সবশেষে একজনের কথা না বলে পারলাম না | বালক ক্ষুদিরাম যদি বেঁচে থাকত, সে কিভাবে দেখত তার নেতার এই ত্রস্ত 'ঋষিত্ব' ? 


আবার একটি কথা মনে পড়ে গেল | অরবিন্দশিষ্য, দ্বিজেন্দ্রতনয়, সুৃভাষসুহৃদ দিলীপ কুমার রায়ের প্রভূত প্রচেষ্টা সুভাষকে অরবিন্দ পাদপদ্মে প্রণত করার, প্রচণ্ডভাবে প্রতিহত হয় ওই পবিত্রাত্মার দ্বারা যিনি স্বামীজীর চরণে মস্তক অগ্রিম সমর্পণ করেছেন | দিলীপের প্রবল প্রয়াস ব্যর্থ সাব্যস্ত হয় কারণ সুভাষ অরবিন্দসত্তার সংবাদ এতদিনে পেয়ে গেছেন ও তার তাৎপর্য অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছেন | তাই দলভারী করা আর গেল না | সুভাষ স্বামীজীরই রইলেন | এতে অরবিন্দ অবশ্যই প্রসন্ন হননি, সে তাঁর তৎকালীন ও ভবিষ্যতের সুভাষসম্বন্ধীয় বক্রবক্তব্যেই প্রতীত | সুভাষের ভারতমুক্তিহেতু অক্ষশক্তির সাহায্য প্রার্থনাকে, বিশেষত জাপানী বাহিনীর সাহায্যে বৃটিশশাসিত ভারত আক্রমণকে শ্রীঅরবিন্দ দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার আক্ষা দিয়েছিলেন | এ তথ্য অরবিন্দ আশ্রম থেকেই প্রকাশিত ও তাঁর দিলীপ রায়কে লেখা চিঠিপত্রে সংকলিত | অরবিন্দ জানতেন যে সুভাষের তীক্ষ্ণ ধীশক্তিতে সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে গেছে তাঁর (অরবিন্দের) বিপ্লববাদ ও আধ্যাত্মিকতার অছিলায় তাঁর বিপ্লবকে বাদ দেওয়া | তিনি এও জানতেন দিলীপমারফৎ যে তাঁর তথাকথিত অবতারত্ব, ঈশ্বরত্ব, অধিমানস শক্তির অবতরণ সুভাষ মানতেন না এবং এইটি ছিল তাঁর সুভাষের কাছে বড় হার | তাই হয়ত তাঁর সুৃভাষ সম্বন্ধে নানা কটুক্তি | সুভাষও তাঁর সম্বন্ধে সত্যভাষণ করতে পিছপা হননি, সে বক্রবাকেই হোক না কেন | 


অতএব, এই হল হক কথা -- বাপু, কবিতা লেখা, গান রচনা করা, গল্প-উপন্যাস লেখা, ছবি আঁকা, আশ্রম করা, বিদ্যালয় -বিশ্ববিদ্যালয় করা, নাইট উপাধি প্রথমে বিপ্লবীদের রক্তে রাঙা বর্বরহস্ত হতে গ্রহণ করা ও পরে উথলিত স্বদেশপ্রেমে বর্জন করা এবং যোগবিয়োগগুণভাগসাধনা করা অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ কিন্তু ফাঁসিকাঠে হাসতে হাসতে প্রাণ দেওয়া বিস্তর কঠিন | তাই কে যে নেতা আর কে অনুগামী বিপ্লবে, তা যথার্থ নির্ণয়ের সময় এসেছে এবার | বীরের জয় হোক ! বন্দে মাতরম !


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment