Friday 27 September 2024

সুলেখা বসু প্রশ্নের উত্তরে




সুলেখা বসু প্রশ্নের উত্তরে

☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆


Sulekha Basu : আপনার এই বার্তা দিকে দিকে আলো জ্বালুক । কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে জাগছে---যারা already এই ভাবধারার অন্তর্ভুক্ত, তারা কতটা কাজের জায়গাতে তা প্রয়োগ করে/করতে পারে ।


Sugata Bose : শুভেচ্ছাজ্ঞাপনের জন্য প্রথমেই ধন্যবাদ | আপনার প্রশ্নটি সঙ্গত | পাঠ করা এক, পালন আর এক | মন, মুখ ও কাজ---এই ত্রয়ীর সমন্বয়সাধন সহজ নয়, আয়াসসাধ্য, তপঃপ্রাপ্ত | তাই ঠাকুর বারবার বলতেন, "কিছু কর্ম কর |" 


মানুষের এই সমাজ ভিন্ন ভিন্ন সংস্কারসম্পন্ন ব্যক্তি ও দলের সমষ্টি, বিবর্তনের বিভেদহেতু সংস্কৃতির বহু স্তরবিন্যাসে বিভক্ত | এই পরস্পর পরস্পরের অসমসম্বন্ধ, রিপুর অসমসঞ্চালন, জ্ঞানের অসমপ্রকাশ, বীজের অসমশক্তি, ইতিহাসের অসমসংঘটন---এই সব নানা কারণে ত্রিগুণের বৈষম্যক্রীড়া | ফলে সমাজে বিদ্যা ও অবিদ্যার ক্রমাগত টানাপ'ড়েন | এই আন্দোলনের নামই জীবন, ব্যষ্টিভাবেও, সমষ্টিভাবেও | এই আন্দোলনের একটি বৃত্তাকার গতি আছে যা হল প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির গাণিতিক যোগফল | সেই যোগফল যখন স্বর্ণাক্ষের (the axis of gold or the golden mean) ঊর্ধ্বে থাকে, তাকে বলি ধর্মরাজ্য, আর তা যখন তার নীচে থাকে, তাকে বলি অধর্মরাজ্য | এই গুণান্দোলন চলতেই থাকে, হেগেল যাকে dialectics বলেছেন অন্য পরিভাষায় | এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে আমরা সাধারণ মানুষ বিবর্তনের এই আন্দোলনচক্রে যখন পিষ্ট হই, তখন পরিত্রাণ পাব কি করে ? প্রশ্নটি স্বাভাবিক কিন্তু তার উত্তর নিগূঢ় |


মার্ক্সবাদ এর জড়বাদী বিশ্লেষণ করেছেন ও উদ্ধারের উপায় নিরুপণ করেছেন | এটি গূঢ় দর্শন যার অনেকাংশিক যাথার্থ সত্ত্বেও মানবিক বাস্তবপ্রয়োগ বিবর্তনের বর্তমান অবস্থায় প্রায় অসম্ভব | এর কারণ মানুষের অসংযত মন যার সংযম সহজ নয়, সাধারণে প্রায় অসম্ভব, তাই ন্যায়ের বিধান দ্বারা তাকে কর্মক্ষেত্রে সংযত রাখার কৌশল | এটি বাহ্য উপায়, তাই এর ব্যর্থতা প্রায়ই প্রকাশ পাবে, এটিই স্বাভাবিক | আর যেখানে একনায়কতন্ত্র অথবা একদলীয়তন্ত্র, সেখানে ক্ষমতাবান স্বভাবতই জনসাধারাণের ওপর অত্যাচার করবেন দার্শনিক আদর্শগত কারণ দেখিয়ে তার যৌক্তিকতা ও আবশ্যকতাকে প্রমাণ করার প্রয়াসে | ফলে সমস্যা সমস্যার জায়গাতেই থেকে যাবে, ন্যায়, সাম্য, মানবতা---এসব কথা পুঁথিগতই রয়ে যাবে, বাস্তবে তার অস্তিত্ব থাকবে না | তার পরিবর্তে স্বৈরাচার, অনাচার, দুরাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, স্বাধীনতালোপ, পুলিশপ্রশাসন---এইসবই একদা-বিপ্লবী মানুষের কপালে জুটবে | সাম্যের নামে নেমে আসবে Party Rule, Dictatorship of the Proletariatএর নামে নেমে আসবে পর্যায়ক্রমে Dictatorship of the Central Committee, Dictatorship of the Politburo, পরিশেষে Dictatorship of the General Secretary of the Communist Party. অতএব, স্বৈরাচারী Czarএর পরিবর্তে আরও ভঙঙ্কর Stalinist একনায়কতন্ত্র সর্বসাধারণের কন্ঠরোধ, শ্বাসরোধ করবে | অধ্যাত্মচেতনাহীন জড়বাদী রাজনৈতিক দর্শন যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তখন এই রকমই হয়ে থাকে | ইতিহাস সেই রকমই সাক্ষ দেয় | তাই জনজীবনে অধ্যাত্মচেতনা একান্ত আবশ্যক | এইখানেই বিবেকানন্দের আবির্ভাব, সমাজজীবনে ধর্মের আন্তর অনুশাসনের আবশ্যকতা যা সামান্য জৈবশিক্ষার দ্বারা সম্ভব নয়, এমনকি সামান্যপাঠেও সম্ভব নয়, যে কথার উত্থাপন আপনি করেছেন ও যার সাথে আমি সহমত |


স্বামীজী বলেছিলেন, "জগতে এমন কোনো সমস্যা নেই শিক্ষারূপ মহৌষধি যার সমাধান করতে পারে না |" অতএব, যদি স্বামীজীর আপ্তবাক্যে আস্থা থাকে, এটি সুনিশ্চিত যে উপযুক্ত শিক্ষার দ্বারা জগতের সমস্ত সমস্যার, এমনকি জগতরূপ সমস্যারও সমাধান পাওয়া যাবে | ভারতসভ্যতার ঊষালগ্নে এই বাণীই তো উত্থিত হয়েছিল ঋষিবক্ষে, ধ্বনিত হয়েছিল আপ্তকন্ঠে | শৃন্বন্তু !


সমস্যা প্রয়োগে | এটি সামাজিক নিরিখে একটি গাণিতিক সমস্যা যার সমাধানও গণিতে | সমাজ এক বৃহৎ সম্মেলন | তার কর্মের যোগফল বহুধাবিভক্ত, বহুবিস্তৃত, ব্যাপকবিন্যস্ত, সহজে অনুমেয় নয় সূক্ষ্মরূপে কিন্তু তার স্থূল প্রকাশ দিবালোকের ন্যায় প্রতীত | কর্মের দুটি দিক---একটি সূক্ষ্ম কারণরূপে, আর একটি স্থূল প্রকাশরূপে, বহির্ফলনরূপে | ন্যায়বিচারব্যবস্থা বাইরের দিকটিকে নিয়ে, শিক্ষা অভ্যন্তরীণ আঙ্গিকে ক্রিয়াশীল | 


মানুষের মস্তিষ্ক ভাবের দ্বারা সঞ্চালিত, পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত, স্নায়ুসমূহ ক্রমসংযুক্ত, মনুষ্যশরীর ক্রমবিবর্তিত | তাই শিক্ষা সভ্যতার সূচক, পালক, রক্ষক ও দুঃসময়ে পরিত্রাতা | ঠাকুর বলতেন, "মন ধোপাঘরের কাপড় | যে রঙে ছোপাবে, সেই রঙে ছুপে যাবে |" আবৃত্তির ব্যবস্থা তাই প্রাচীন শিক্ষাপ্রণালীতে, অর্থাৎ, বারংবার একই মন্ত্রোচ্চারণ, তার সূক্ষ্মাংশের নির্যাস স্নায়ুকেন্দ্রে অনুপ্রবেশের নিমিত্ত | ভারতের সভ্যতা, সংস্কৃতি এই আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার দ্বারা পুনঃপুনঃ জাত, পালিত, সংরক্ষিত হয়েছিল যুগযুগ ধরে যতদিন না সমাজে জনবর্ধনের ও তৎসাপেক্ষে নানা বৈষম্যহেতু সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে ও বহির্বর্বরশক্তির আক্রমণে পরাভূত হয়ে বৈদেশিক সংস্কৃতির দ্বারা আক্রান্ত হয় | সনাতন ধর্মের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে সমাজে পতনের সম্যকসূচনা এভাবেই হয় | বিষয়টি গূঢ়, দুকথায় বোঝানো দুষ্কর, তবু প্রযত্ন করলাম স্বল্পশব্দবন্ধে ব্যাখ্যা করার | স্বামীজী এই সাপেক্ষে বলেছিলেন, "মুসলমান আক্রমণের পূর্বে ভারতবর্ষে 'murder' শব্দটির প্রচলন ছিল না |" ইতিহাস পড়লে দেখা যাবে কিভাবে সনাতন সংস্কৃতির সর্বনাশসাধন সংঘটিত হয়েছে সহস্রাধিক বর্ষ ধরে |


সমাজের বিকার আজকের নয় | এর পেছনে সহস্রাধিক বর্ষব্যাপী বৈদেশিক শক্তিসংস্কৃতির দাসত্ব বিদ্যমান যা 'শক হুন দল মোগল পাঠান এক দেহে হল লীন' বলে সমন্বয়ের আপাতমধুর সম্ভাষণে সমাজের কল্পিত অমৃতহ্রদে নিমজ্জিত করা যাবে না | রবীন্দ্রনাথের কাব্যোক্তি অভ্রান্ত কিন্তু তার বিশ্লেষণ বিদ্বজ্জন দ্বারা প্রায়শঃ বিক্ষেপকারী, অসত্য | এই সহস্র বর্ষের পরশাসনের কথা তুললেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে তার আগে কি সমাজে ঘোর দুর্নীতি ছিল না ? সবই কি বিশুদ্ধ গাঙ্গেয় পদার্থ ছিল ? প্রশ্নদ্বয় সঙ্গত | ছিল | দুর্নীতি, পাপ, হত্যা, অবৈধাচরণ সবই ছিল কিন্তু তা ছিল তুলনামূলকভাবে ন্যূনতম যা বিদেশী পর্যটকদের ভারতবৃত্তান্তে সুস্পষ্টভাষায় লিপিবদ্ধ, প্রমাণিত | ভারত যুগযুগ ধরে ধর্মের দেশ, সভ্য, সুসংস্কৃত, শিক্ষিত, পরিমার্জিত আচরণের ধর্মক্ষেত্র, পৈশাচিক আচরণের অরণ্য ছিল না | বিশ্বের ইতিহাস পাঠ করলেই বোঝা যায় এই ভারতস্বাতন্ত্র যা মোহিত করেছে প্রখ্যাত পর্যটকদের, প্রলুব্ধ করেছে বর্বর প্রজাতিদের ভারতলুন্ঠনপ্রকল্পে, পরিশেষে ভারতবিজয়ে | যদি ৭১২ সাল হতে পর্যায়ক্রমে ভারতের অধিকৃত অংশের ইতিহাস দেখি, তাহলে দিবালোকের ন্যায় পরিষ্ফুট হয় ভারতের সাংস্কৃতিক তথা নৈতিক পতনের চিত্র | তত্ত্ব যদিও আরও গভীর, আলোচনার স্বল্পপরিসর ক্ষেত্রে আনা সম্ভবপর নয় | এ গেল একদিক, বলপ্রয়োগে সভ্যতার বিনষ্টিকরণ | এর আগে বৌদ্ধযুগের শেষ ৫০০ বছরে বৌদ্ধদের জঘন্য বামাচার ভারতভূখণ্ডকে পাপে লিপ্ত করে সার্বিকভাবে দুর্বল করেছিল যার ফল মুসলমান আক্রমণ ও তৎপশ্চাৎ দাসত্ব | কিন্তু বৌদ্ধযুগে সনাতন ধর্ম পালনে বাধা ছিল না, ধর্মসভায় অবাধে বাদানুবাদ প্রচলিত ছিল, তলোয়ারের আগায় জোর করে ধর্মান্তরিত করার প্রচলন ছিল না | মানুষ স্বাধীন চিন্তাভাবনা করতে পারতেন, নিজভাব নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারতেন | এ সবে বাধা আসে মুসলমান যুগে | পরে ইয়োরোপীয় ঔপনিবেশিকতার কালে বাংলা তথা ভারতজাগরণ স্বাধীন চিন্তার মুক্তাঙ্গনে সূচিত হয় যদিও খ্রীষ্টান ধর্মযাজকেরা অগণিত হিন্দুকে নানা অছিলায়, নানা প্রলোভনে দলে দলে ধর্মান্তরিত করেছেন | এহেন বিজিত ভারতে বিবেকানন্দের অভ্যুত্থান আলোকবর্তিকারূপে |


স্বামীজীর জন্ম (১৮৬৩) ভারতবিদ্রোহের (১৮৫৭) মাত্র ছয় বছর পর | তখনও বৃটিশের বারুদের গন্ধ মেলায়নি, বিলীন হয়নি স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের জয়ধ্বনি, পরে শাসকের নির্মম অত্যাচারে আর্তনাদ | বালক নরেন্দ্রনাথ সংবেদনশীল, বেপরোয়া, বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন, গভীর মননশীলতাসম্পন্ন এক অগ্নিগর্ভ আধার যার আগমনবার্তা দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছে গিয়েছিল জন্মলগ্নে | শ্রীরামকৃষ্ণ নিজমুখে বলেছেন যে তাঁরই আবাহনে স্বামীজীর মর্ত্যে আগমন জগতপরিত্রাণকল্পে | 


তখন ভারত শৃঙ্খলিত ঔপনিবেশিক দাসত্ববন্ধনে | বৃটিশের অত্যাচার তুঙ্গে | সনাতন ধর্ম বিপন্ন খ্রীষ্টান ধর্মপ্রচারকদের ধর্মান্তকরণ প্রকল্পের দ্বারা, সনাতন সংস্কৃতি আক্রান্ত ইয়োরোপীয় জড়বাদ তথা ভোগবাগের দ্বারা | বিপ্লবের বহ্নিশিখা প্রশাসকের প্রতিহিংসার পুরু আস্তরণে চাপা কিন্তু ধিকিধিকি জ্বলছে | এই অগ্নিগর্ভ আবহাওয়ায় বালক, কিশোর, তরুণ বিবেকানন্দ বেড়ে উঠছেন অন্তরে সহস্র সমস্যার সমাধানের সন্ধানে |


দক্ষিণেশ্বরে, কাশীপুরে, ভারতপরিক্রমায়, কন্যাকুমারিকায় সমস্যার সমাধান পেলেন অজ্ঞাতনামা সন্ন্যাসী | হয়ে উঠলেন জগতমঞ্চে বিশ্ববরেণ্য বিবেকানন্দ | ভারতকে চিনলেন, জানলেন নিজসাধনলব্ধ অনুভূতির মধ্য দিয়ে শ্রীগুরুর অযাচিত, অহেতুক কৃপায় আর নিজ বিরাট হৃদয়ের সংবেদনশীলতায় | পাশ্চাত্যে দেখলেন জগতের আর এক রূপ, প্রগতিশীল জড়বাদের চূড়ান্ত পরিণতি | বুঝলেন নিজঅবতারত্ব ও তাঁর জগতোদ্ধারকল্পে যুগধর্মসংস্থাপনের মহতী কর্মের তাৎপর্য ও পরিব্যাপ্তি | শুরু হল ভবব্যাধি নিরাময়ের মহৌষধি প্রস্তুত যা হিমাদ্রিভেদী নির্ঝরের ন্যায় অবিশ্রান্ত নিঃসৃত হতে থাকল, তৎপরে দুর্বার স্রোতস্বিনীর ন্যায় অমৃতভাষণে অবিরাম প্রবাহিত হল ব্রহ্মর্ষির শ্রীমুখ হতে বিশ্ববাসীর চিৎসমুদ্র অভিমুখে | যেদিন স্বামীজীর দেহাবসান হল, সেদিন পড়ে রইল অমূল্যরতন ওই সকল দেববাণী যা নববেদ, এ যুগের শ্রুতিস্মৃতিদ্বয় |


একদিন যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে স্বামীজী নিজে হতবুদ্ধি হয়েছিলেন কি করে বিরাট জগতসমস্যার সমাধান করবেন | পরে ভারতভূখণ্ডের সমুদ্রস্থিত শেষ শিলাপ্রান্তে বসে ধ্যানের গভীরে যে সমাধান খুঁজে পান, তাই তিনি বিশ্ববাসীকে উদাত্তকন্ঠে শুনিয়ে যান যেমন শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের নবীন ঋষি 'বহুযুগের ওপার হতে' শুনিয়েছিলেন আত্মার অমৃতবাণী | স্বামীজী সেই ঋষিবংশের শেষ প্রতিভূ যিনি আধুনিক যুগে সনাতন আদর্শের উপস্থাপক, প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্লেষক ও প্রতিমূর্তি | তাঁর জীবন ও বাণী অনুসরণে বিশেষ ফললাভ হবে, এই আমার বিশ্বাস কারণ এমন পূর্ণাঙ্গ দর্শন ও সর্বগ্রাসী প্রয়োগসম্ভাবনা আর কোনো মহামানবের মধ্যে দেখি না | ঠাকুর তাঁকে শুধু মর্ত্যে আকর্ষণ করেন নি, তাঁকে শক্তিপ্রদান করেছেন, পরিশেষে তাঁর দেহমধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে একীভূত হয়েছেন | মর্ত্যলীলার শেষপ্রান্তে বসে কাশীপুরে লিখে দিলেন স্বহস্তে, "নরেন লোকশিক্ষা দিবে, যখন ঘরে বাইরে হাঁক দিবে |" অন্যত্র আরও বলেছেন, "এবার নরেনের জন্যই আসা |" আবার, "কেশব, বিজয়ের মধ্যে দেখছি জ্ঞানের একটা শক্তি রয়েছে | আর নরেনের মধ্যে দেখছি ওরকম আঠারোটা শক্তি বিদ্যমান | নরেন জ্ঞানসূর্য |" আরও কত বলছেন---"নরেন্দ্রর অনেক গুণ | গাইতে, বাজাতে, পড়াশোনায়; আবার জিতেন্দ্রিয়---বলেছে বিয়ে করবে না |" "ও শুকদেব, ধ্যানসিদ্ধ |" এরকম অজস্র প্রশংসা করতেন ঠাকুর তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ শিষ্যের | এর থেকে বড় স্বীকৃতি আর জগতে কি হতে পারে ? শিকাগো ধর্মমহাসভায় মুহূর্তে বিশ্ববরেণ্য হওয়া এর কাছে তুচ্ছ প্রাপ্তি | স্বয়ং ভগবানের শ্রীমুখ হতে বন্দনা, "এতদিন পরে আসতে হয় ? বিষয়ীদের সাথে কথা বলতে বলতে আমার জিব পুড়ে গেছে, আমার পেট ফুলে গেছে | জানি তুমি সেই পুরাতন ঋষি নরনারায়ণ, জীবের দুঃখে কাতর হয়ে এসেছ |" কাশীপুরে মহাসমাধির দুদিন পূর্বে নরেন্দ্রনাথ শ্রীগুরুর পদপ্রান্তে বসে ভাবছেন, "এই দুঃসহ কর্কটরোগযন্ত্রণার মাঝে যদি বলেন উনি ঈশ্বর, তো মানি |" তৎক্ষণাত অর্ধনিদ্রিত শ্রীরামকৃষ্ণ বলে ওঠেন, "এখনও অবিশ্বাস ? তবে এই দেখ !" বলে একবার রামরূপ ধারণ করলেন, একবার কৃষ্ণরূপ ধারণ করলেন, তারপরই উভয়রূপ রামকৃষ্ণরূপে বিলীন হল | নরেন্দ্রনাথ বিষ্ময়বিস্ফারিত নেত্রে এই অপার্থিব দৃশ্য দেখলেন, সংশয় দূরীভূত হল | যুগাবতার সংশয়রাক্ষসনাশমহাস্ত্রংরূপে যুগনায়কের সামনে আত্মপ্রকাশ করলেন | 


এই বৃত্তান্ত রামেন্দ্রসুন্দর ভট্টাচার্যের জবানবন্দিতে আছে উদ্বোধন পত্রিকায় যার ইংরেজি অনুবাদ ২০০৭ সালের অগস্ট সংখ্যায় Prabuddha Bharat পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে | আমার মা সম্ভবতঃ ১৯৮৭ সালের কোনো এক বুধবার কথামৃতপাঠের এক সন্ধ্যায় এই কাহিনী পূজনীয় লোকেশ্বরানন্দজীর কাছে 'রামকৃষ্ণ মিশন ইন্স্টিটিউট অফ কালচারে' শোনেন ও আমায় বাড়ী ফিরে এসে মহা উত্তেজনায় বলেন | নিজ চক্ষুকর্ণের সংশয় মেটাতে পরবর্তী বুধবার কথামৃতপাঠশেষে আমি পূজ্যপাদ লোকেশ্বরানন্দজীকে ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি করতে অনুরোধ করি | মহারাজ কয়েক মুহূর্ত রঞ্জনরশ্মিসমদৃষ্টিতে আমায় পর্যবেক্ষণ করে বলতে শুরু করেন | "এ কথা আমরা পরম্পরাক্রমে বেলুড় মঠে জেনে এসেছি | বাইরে বলার প্রচলন নেই | প্রাচীন সাধুদের মুখে শোনা কথা | ঠাকুর কাশীপুরে স্বামীজীকে একবার রাম এবং একবার কৃষ্ণরূপে দর্শন দেন | পরে ওই দুই রূপ নিজ দেহে সংবরণ করে নেন |" মহারাজের বলা কাহিনী সংক্ষেপে বললাম পুনরাবৃত্তি এড়াতে কিন্তু তা রামেন্দ্রসুন্দর বাবুর কথনের সাথে হবহু মিলে যায় | প্রমাণস্বরূপ আলোকচিত্র সংযোজিত হল এই প্রলম্বিত উত্তরান্তে |


যাঁরা সংশয়বাদী, যাঁরা জড়বাদী, যাঁরা নিরীশ্বর, তাঁরা উপরোক্ত কাহিনী ও ঠাকুরের নরেন সম্বন্ধে উক্তি অনেকাংশেই হয়ত' মানবেন না কিন্তু একই সূত্রে তবুও বহুশ্রুত পরবর্তী ঘটনাটির কথা না বললেই নয় | কাশীপুরে ঠাকুরের দেহ যাবার দিনকয়েক আগে একদিন ঠাকুর নরেনকে ডাকলেন তাঁর দোতলার ঘরে | পরে দরজা বন্ধ করে তাঁর কাছে বসতে বললেন | এরপর একদৃষ্টে ঠাকুর প্রিয় শিষ্যের দিকে চেয়ে রইলেন ও শিষ্যের অনুভব হতে লাগল কি যেন এক তড়িৎতরঙ্গের ন্যায় শক্তি ঠাকুরের দেহ হতে নির্গত হয়ে তাঁর দেহে প্রবিষ্ট হচ্ছে | কিছুক্ষণ এইভাবে থাকার পর নরেন্দ্রের বাহ্যচৈতন্য লোপ পেল | পরে সংজ্ঞা ফিরে এলে দেখেন অশ্রুসিক্ত ঠাকুর বলছেন, "আজ তোকে আমার সর্বস্ব দিয়ে ফকির হলাম | তুই এই শক্তি দিয়ে জগতে অনেক কাজ করবি |" ঠাকুরের এই নরেন্দ্রনাথের সাথে একীভূত হওয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ | এর অর্থ শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রপরবর্তী স্বামীজী এক ও অভিন্ন ব্যক্তি | ঠাকুরের নরেন্দ্রদেহমনে অনুপ্রবিষ্ট হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণেই বাস্তবিক স্বামীজীর জন্ম | তাই তিনি ত্রিজ | প্রথম জন্ম ভুবনেশ্বরীগর্ভ হতে ১২ জানুয়ারী, ১৮৬৩ | দ্বিতীয় যুগ্মজন্ম সাম্ভবী দীক্ষান্তে দক্ষিণেশ্বরে ও রামমন্ত্রে দীক্ষান্তে কাশীপুরে রামকৃষ্ণ পদপ্রান্তে | আর এই সর্বশেষ তৃতীয় জন্ম কাশীপুর উদ্যানবাটিতে ঠাকুরের নরেন্দ্রদেহমনে অনুপ্রবেশ ও পূর্ণাধিষ্ঠানের মধ্যে | দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর একদিন নরেন্দ্রের হুঁকো থেকে টান দেওয়ায় যখন নরেন্দ্র বলে ওঠেন, "মশায়, কি করেন ? ওটা যে আমার এঁটো," তখন ঠাকুর বলে বসেন, "বলিস কিরে ? তুই আর আমি কি আলাদা ?" কাশীপুরে সেই আবাহনের পূর্ণাহুতি হল | নরেন্দ্র ভাবী বিবেকানন্দে রূপান্তরিত হলেন | শ্রীরামকৃষ্ণ লোকচক্ষু হতে অন্তর্হিত হওয়ার ঠিক পূর্বে নরেন্দ্রদেহ আশ্রয় করলেন বিশ্বব্যাপী লোককল্যাণার্থে |


এই স্বল্পপরিসর রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সম্পর্কবৃত্তান্ত পরিবেশিত হল যাতে সমাজজীবনে বিলুপ্ত শ্রদ্ধা ফেরাতে বিবেকানন্দচর্চা যে কি অপরিহার্য তা পাঠক বোঝেন | যাঁকে স্বয়ং ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ এনেছিলেন হৃত ধর্মসংস্থাপনের জন্য, সেই সপ্তর্ষিমণ্ডলস্থিত ধ্যানমগ্ন ব্রহ্মর্ষিকে মানুষ চিনলেন কই ? তাই এই সামান্য প্রয়াস | বিবেকানন্দপাঠে জাতির মেরুদণ্ড ঋজু হবে, চরিত্র বলিষ্ঠ হবে, বুদ্ধি পরিষ্কার হবে, বোধের উদয় হবে---এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস | এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে বিবেকানন্দপাঠে সত্যিই কি ব্যক্তি তথা সমষ্টিজীবনে যথার্থ কোনো পরিবর্তন আসবে ? কর্মক্ষেত্রে তার কি যথাযথ প্রয়োগ হবে ? সম্ভবতঃ সেভাবে হবে না কারণ উপযুক্ত আধার না হলে চরিত্র গঠিত হয় না, সে যতই মানুষ শাস্ত্রপাঠ করুন | ঠাকুরের ভাষায়, কাচে কালি (silver nitrate) লাগানো না থাকলে ফোটো ওঠে না | ভোগ সমাপ্ত না হলে যোগ অসম্ভব | কিন্তু যেমন বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানপাঠ করলেই শিক্ষার্থী বৈজ্ঞানিক হন না, অথচ তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা অবশ্যই কিয়ৎ আসে, ঠিক তেমনই বিবেকানন্দপাঠের সুফল আছেই | তার দ্বারা বুদ্ধির বিকাশ, চৈতন্যের প্রাক-উন্মেষ, হৃদয়ের প্রসারতা, চরিত্রের দৃঢ়তা---এই সব স্বল্পাধিক অবশ্যই হয় | তাই বিবেকানন্দপাঠ সমাজগঠনে ফলদায়ী | পাঠকদের মধ্য হতে হয়তো বা কারো মনে দাবানলের ন্যায় উচ্চ আদর্শবোধ প্রজ্বলিত হয়ে সমস্ত দুর্বলতাকে ভস্মিভূত করল | একটি মানুষ তৈরি হল | স্বামীজী বলছেন, "একটা মানুষ তৈরি হলে লাখ বক্তৃতার ফল হবে |" সেই সব জাগ্রত আত্মা আবার জীবনদীপ অন্যান্য মানুষের হৃদয়ে জ্বালিয়ে দেবেন | এভাবেই ভাবান্দোলন ধীরে ধীরে প্রসারিত হবে | একদিনে যেমন অবক্ষয় হয় না সমাজে, দীর্ঘদিনের অপকর্মের দ্বারা সংঘটিত হয় তা, তেমনই একদিনে আলোকপ্রাপ্ত হয় না সমাজ, দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তপস্যার দ্বারা তা জাগ্রত হয় |


সমাজ যখন নিম্নগামী হয়, সংস্কৃতির যখন হয় অধঃপতন, তখন জানবেন সাধারণের উচ্চভাবধারণক্ষমতা হ্রাস পায় | এমত অবস্থায় গুটিকতক চিহ্নিত মানুষই আধ্যাত্মিক ভাবান্দোলনের সূচনা করেন | 'কালেনাত্মনি বিন্দতি'---এই সূত্রের যাথার্থ তখন বোধ করেন প্রাজ্ঞজন | সময় না হলে যে বীজ পু্ষ্পিত, পল্লবিত, ফলবান বৃক্ষে রূপান্তরিত হবে না---এ তো সাধারণ জ্ঞান | একই নিয়ম মনোজগতেও | সময় না হলে গুণের উৎকর্ষসাধন হয় না | অভিজ্ঞতার আলোয় অন্তরের আলো ক্রমবিকশিত হয় | এর জন্য চাই সময় | সেই সময় দিতেই হবে সমাজকে বিবর্তিত হওয়ার জন্য | তার মানে কি এই যে হাত গুটিয়ে বসে থাকব নদীর পারে, জলের তরঙ্গ কমলে পার হব বলে ? তা হলে তো অনন্তকালের প্রতীক্ষায় পরিণত হবে সেই পার হওয়া, কালেনাত্মনি বিন্দতিও বিফল হবে | তাই পূর্ণ উদ্যমে, মহা উৎসাহে বিবেকানন্দপ্রচার প্রয়োজন যাতে মাত্র বৈতরণীপারের তরণী না মেলে, ইহজীবনেরও নদীপথ পারাপারের জলযান মেলে |


বিবর্তনের বর্তমান অবস্থায় মানুষ অধিকাংশই তমোগুণী, অর্থাৎ, তমসাছন্ন চেতনা | রজোগুণে সৃজনকর্ম হচ্ছে বটে কিন্তু তা রিপুর দংশনে তমোপ্রায় | সমাজে সত্ত্বগুণ প্রায় শূণ্য | স্বার্থবুদ্ধিদ্বারা পরিচালিত মানুষ যে শুধু 'চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা'---এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে জীবন অতিবাহিত করবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি ? স্বামীজী উপরোক্ত স্বার্থমন্ত্রটির ঘোর নিন্দা করেছেন ও সে যুগের তরুণদের প্রাণে দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনকল্পে নিঃস্বার্থপরতার আগুন জ্বালিয়েছেন | কিন্তু দেশকে স্বাধীন করতেই দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানেরা আত্মবলিদান দিয়েছেন | পড়ে রয়েছে অপেক্ষাকৃত নির্বীর্যের দল যাঁরা উচ্চ ভাবগ্রহণে সমুৎসুক নন, তা জীবনে প্রতিপালনেও অকৃতকার্য | এই ভাবটি আমরা স্বামীজীর রচনায় পাই | রবীন্দ্রনাথও তাই একইভাবে গান্ধীজীর কাছে অনুযোগ করেছিলেন যে উনি স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিচ্ছেন আর শান্তিনিকেতনে শিক্ষালাভের জন্য মাঝারি মেধার ছেলেমেয়েদের পাঠাচ্ছেন | কবির বক্তব্যটি উপরোক্ত আলোচনার নিরিখে দেখলে বোঝা যায় উনি কি বোঝাতে চেয়েছিলেন | স্বাধীনতার পর এর ফল ভোগ করছি আমরা | বাঘা যতীন, মাস্টারদা, রাসবিহারী বসু, নেতাজী, ভগত সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, রামপ্রসাদ বিসমিল, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী, আশ্ফাকুল্লা খাঁ, ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকি, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, আরও অগণিত বীরবীরাঙ্গনাকে আমরা স্বাধীনতাযজ্ঞের যূপকাষ্ঠে হারিয়েছি | দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ নায়কনায়িকাদের হারিয়ে বিভাজিত স্বাধীনতা পেয়েছি আর তা যথাযথভাবে রক্ষা করা, পালন করা, পুষ্ট করার মত নিবেদিত প্রাণ আর পাইনি | ফলে পরবর্তী প্রজন্ম আর সেভাবে জাত, বর্ধিত হয়ে উঠতে পারে নি | ক্রমে আদর্শচ্যূত, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে | শাসনভার গেছে দুর্বৃত্তদের হাতে, আইনপ্রনয়ণ আইনত অভিযুক্তদের হাতে | সর্বত্র দুষ্টের প্রভাব | শিষ্টের সহজশ্বাসের অবকাশ নেই আর | এহেন পরিস্থিতিতে বিবেকানন্দরূপ মহৌষধিরই একান্ত আবশ্যকতা সভ্যতারক্ষার্থে |


বিবেকানন্দ ছিলেন রোমা রোঁলার ভাষায় 'মূর্তিমান শক্তি' | যাঁরা যৌবনবয়স হতে নিয়মিত বিবেকানন্দ পাঠ করে আসছেন, তাঁরা অবশ্যই এই শব্দদ্বয়ের যাথার্থ স্বীকার করবেন | এই শক্তি তাঁদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েই তো তাঁদের জীবন ও কর্ম দেশসেবার পথে পরিচালিত হয়েছে | ভুলত্রুটি সব মানুষেরই হয়ে থাকে কখনও কখনও কিন্তু তার দ্বারা বিবেকানন্দপ্রাণিত হয়ে যে পরিবর্তিত জীবনধারা, তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই | এই সব মানুষই তো বিরাট রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলন গড়ে তুলেছেন যা আজ শতাধিক বর্ষ ধরে নিঃশব্দে লোকহিতায় কাজ করে চলেছে |


এখন প্রশ্ন হচ্ছে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের অনুগামীরাও কি আজ আর তাঁদের যুগ্ম দিব্যপুরুষের পদাঙ্ক যথাযথভাবে অনুসরণ করছেন, তাঁদের আদর্শ ঠিক ঠিক পালন করছেন ? নাকি আদর্শের অপলাপ হচ্ছে সেখানে ? এই সূত্রে শ্রীমা সারদা দেবীর একটি বাণী প্রণিধানযোগ্য | "অবতারের চেয়ে মহামায়ার শক্তি বেশি |" কথাটির তাৎপর্য ছিল এইরকম, আজও আছে তাই---মানুষ সহজেই অবিদ্যার বশবর্তী হন কারণ মন স্বভাবতই নিম্নগামী | অবতার বিশ্বমানসকে ঊর্ধ্বগামী করার সাধনা করেন তাঁর তপস্যাদ্বারা, প্রচারদ্বারা, জনজীবনে শক্তিক্ষেপণদ্বারা কিন্তু কালক্রমে বিফল হন অনেকাংশে মানুষের এই স্বাভাবিক নিম্নগামী মনোবৃত্তির জন্য | ইতিহাসে বারে বারে এমনই ক্রমপতন পরিলক্ষিত হয়েছে | রাজবংশের ক্ষেত্রে যা, অবতারের অনুগামীদের ক্ষেত্রেও তা | উত্থান এবং পতনের এই অমোঘ নিয়ম |


এহেন অবস্থা, এহেন ব্যবস্থায় অসাধারণ ত্যাগী ব্যক্তিসকলই আদর্শের উচ্চ ভাব রক্ষা করতে সক্ষম, যাঁরা স্বীয়স্বার্থ ত্যাগ করে বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায় জীবন অতিবাহিত করতে পারেন | সময় অনুকুল নয় বিশ্বব্যাপী ধনতন্ত্রের প্রকোপে এই রকম মানুষের বহুল অস্তিত্বের | তাই যাঁরা সুউচ্চ আদর্শের আপাত অনুগামী, তাঁরা কিয়দংশে মুখে মহাপুরুষ, মনে কতক কপট | আর সাধারণ ভক্তদের কথা ছেড়েই দিলাম | তাঁরা তো মেষপালকের অঙ্গুলিহেলনে চালিত আজ্ঞাবহের দল অথবা ভক্তের বেশধারী ষড়রিপুর দাস | এই দুই শ্রেণীর বিবেকানন্দভক্ত দেখেই আপনার সম্ভবতঃ মনে প্রশ্ন জেগেছে যার সদুত্তর দিতে আমার সুদীর্ঘ প্রয়াস |


এখন অবস্থা তো এই | করণীয় কি ? সংস্কৃতির সর্বনাশ ঘটেছে | ধনতন্ত্রের করালগ্রাসে সর্বসাধারণ ক্লিষ্ট, মোহিনীমায়ায় বিবেকবুদ্ধি লুপ্তপ্রায় | লোভ অধিষ্ঠাত্রী দেবীর আসন গ্রহণ করে মানুষকে মৃত্যুপথে চালিত করছে | সমাজে মূল্যবোধের এতই অবক্ষয় যে দুর্নীতি সহজসহনীয় হয়ে উঠেছে, মিথ্যাচার স্বাভাবিক ঠেকছে, জীবনের উদ্দেশ্য যা বঙ্কিম রহস্য করে বলার জন্য ঠাকুরের কাছে তিরস্কৃত হয়েছিলেন, সেই 'আহার নিদ্রা মৈথুন'ই এখন সর্বগ্রাহ্য ও সর্বগ্রহণীয় বলে প্রতীত হচ্ছে | সভ্যতার সঙ্কটই বটে ! একদিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার স্বল্পকাল পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন 'সভ্যতার সঙ্কট' | বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে আহ্বান জানালেন তথাগত বুদ্ধকে


'নূতন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী,

কর' ত্রাণ, মহাপ্রাণ, আন' অমৃতবাণী |

বিকশিত কর' প্রেমপদ্ম চিরমধুনিষ্যন্দ |

শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,

করুণাঘন ধরণীতল, কর' কলঙ্কশূণ্য ||'


উপরোক্ত পঙ্ক্তিগুলি লেখার পর আট দশক অতিক্রান্ত | এখন গণতন্ত্র কই ? ধনতন্ত্রের যুগ | লোভ নির্লজ্জরূপ ধারণ করেছে যেমন, ধনতন্ত্রের চক্রে পিষ্ট হয়ে মানুষ পশুপ্রায় হয়েছে | এর মধ্যে মূল্যবোধ, আদর্শপরায়ণতা কই যে মানুষ বিবেকানন্দ অধ্যয়ন করবেন বা করলেও তার ধার্মিক, নৈতিক নির্যাস জীবনে পালন করবেন ? যা ঘটেছে এ যাবৎ, যা ঘটছে বর্তমানে, যা সম্ভবতঃ ঘটবে ভবিষ্যতে, তা ঐতিহাসিক, জৈবিক কার্যকারণবশতঃ হয়েছে, হচ্ছে, হবে | এখানে প্রতিকারের প্রশ্ন, নিবারণ, নিয়ন্ত্রণ, সমস্যাজাল হতে নিষ্ক্রমণের নিমিত্ত ভাবনাচিন্তা করতে হবে যে বিষয়ে বিবেকানন্দ যুগান্তকারী সব সমাধান দিয়ে গেছেন | তাই বিবেকানন্দপাঠ এত আবশ্যক, তার বাস্তবরূপায়ণের পথে নানাবিধ বাধাবিপত্তি থাকা সত্ত্বেও |


এবার আসি আপনার মূল প্রশ্নে আর একবার | আপনি প্রশ্ন করেছেন যে যাঁরা এযাবৎ এই (বিবেকানন্দ) ভাবধারার অন্তর্ভুক্ত, তাঁরা কতটা কাজের জায়গাতে তা প্রয়োগ করেন/করতে পারেন, অর্থাৎ, কতটা করেন বা কতটা করার অবকাশ আছে ও করতে সক্ষম হন | ঠিক কথা | খুব কম লোকই প্রকৃতভাবে বিবেকানন্দ ভাবধারার সাথে পরিচিত, আরও স্বল্পসংখ্যক তার সাথে যথাযথ সংযুক্ত এবং তার চেয়েও স্বল্পসংখ্যক মানুষ সেই ভাবধারার অন্তর্ভুক্ত, নিমজ্জিত | এর কারণ কয়েকটি | এক, বেশিরভাগ মানুষ বই পড়েন না আজকাল | দুই, খুব কম লোকের মেধা সুতীক্ষ্ণ ও ধারণাশক্তি ব্যাপ্ত ও গভীর যার দ্বারা সাগরসম বিবেকানন্দভাব তাঁরা যথার্থ অনুধাবন, অনুশীলন ও অনুসরণ করতে পারবেন | এর কারণ অবশ্য কিয়দংশে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রচারবিভাগের অপটুতার ওপর বর্তায় | তিন, রিপুক্লীষ্ট স্বার্থান্বেষী মানুষ বিবেকানন্দের নিঃস্বার্থপরতার ভাব নিয়েও নিতে পারেন না | ত্যাগ সহজ নয় কারণ ভোগস্পৃহাই সাধারণে সহজাত প্রবৃত্তি | বিবেকানন্দের সাথে এই সব ভক্তের অগভীর সম্পর্ক চিত্তের মালিন্যহেতু | চার, যে পরিমাণে আছে আপাত ভক্ত, তার অতি অল্পসংখ্যকই সত্যিকারের ভক্ত যাঁরা জীবনে রূপায়ণ করেছেন ও করেন স্বামীজীর বাণী | সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই পতিত অবস্থায় কোথায় পাবেন ভুরি ভুরি সৎ, চরিত্রবান মানুষ যাঁরা যথাযথ পালন করবেন স্বামীজীর নির্দেশাবলী ? তাই সকল সামাজিক, জৈবিক সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েই প্রচারকার্যে নামতে হবে আদর্শকে উজ্জ্বলরূপে সামনে রেখে সাহসিকতার সাথে | একটি প্রদীপ হতে অপর একটি প্রদীপে অগ্নিসংযোগের দ্বারা ক্রমে লক্ষ লক্ষ প্রদীপ নব আলোকে প্রদীপ্ত হয়ে উঠবে | 'স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ |' স্বল্পপরিসর ধর্মানুষ্ঠানের দ্বারা বিরাট ভয় দূরীভূত হয় | আসুন, সেই বিবেকানন্দপাঠরূপ, প্রচাররূপ ধর্মানুষ্ঠান করি, নিজে সমৃদ্ধ হই, সমাজকে জাগ্রত করি | 🕉

No comments:

Post a Comment