Saturday 28 October 2023

রোমন্থন ... ৩






রোমন্থন ... ৩


কত যুগ পরে এক মানব দেহলাভ! কত সুযোগ ঠাকুরকে পাওয়ার! হেলায় না হারায় যেন | ভোরের আকাশ যে আশ্বাস বহন করে, হৃদয়াকাশে তারই প্রতিধ্বনি, তারই চৈতন্যাভাস | এই জন্মেই পেতে হবে তাঁকে, পরজন্মে কি হবে জানি না |


ঠাকুর ম্যাদাটে ভাব পছন্দ করতেন না, ঢিমে তেতালা লয়ে তাঁর আলুনি লাগত | বলতেন, "কদিন উঠে পরে লাগো দেখি |" কিন্তু মাতালের কি নেশা কাটে? বিকারের রোগী, প্রলাপবাক্যকেই ব্রহ্মবাক্য মনে করে, ভোগকে অমরত্বের পথ |


ছোটবেলায় সোনার কাঠি, রূপোর কাঠির গল্প শুনেছি মায়ের কাছে | অস্পষ্ট মনে আছে | কেমন করে রাজকন্যা ঘুমিয়ে আছে আর সোনার কাঠির স্পর্শে রাজপুত্র তার ঘুম ভাঙাবে | আমাদেরও সেইরূপ | রাজপুত্র এবার স্বামীজী | মাদ্রাজে মোহনিদ্রা ভঙ্গ করলেন দেশের | বললেন, "My India, arise!" ("ভারত আমার, ওঠো!") সহসা কম্পিত হল সহস্র বছর শায়িত ভারতকায়, জাগরণের প্রথম শিহরণ খেলে গেল ওই বিরাট ভূপতিত দেহে | ভারতাত্মার জাগরণের প্রথম লক্ষণ দৃষ্ট হল |


ঠাকুর বললেন, "এবার আসাই নরেনের জন্য |" যুগসন্ধিক্ষণে ভগবান আসেন পতিত নরকুলকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করতে | আনেন তাঁর বার্তাবহ বাউলের দল যার মুখ্য মুখপত্র এবার স্বামীজী, সমাধির গভীর হতে যাঁকে অমৃতস্পর্শে বুত্থিত করে আনলেন প্রভু সিমুলিয়ার দত্তবংশে সভ্যতার রক্ষাকল্পে | দক্ষিণেশ্বরে, কাশীপুরে ঘরে দোর দিয়ে নিভৃতে শেখাতেন মুক্তি মহামন্ত্র | কে জানে এই অদ্ভূত পুরুষকে যাঁর এত রূপ? নরেনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি | ওই প্রেমস্পর্শে জাগরিত হয়েছে তাঁর মহাপ্রাণ | ওই অমোঘ শক্তির কাছে নতি স্বীকার করেছেন তিনি | তাঁরই বার্তাবহরূপে দেশ হতে দেশান্তরে উল্কার ন্যায় ছুটে বেড়িয়েছেন মানুষকে আশ্বাসবাণী শোনাবার জন্য | 'হে মানব, তুমি অমৃতের পুত্র | তুমি পাপী নও | তুমি দেবত্বের অধিকারি, সাক্ষাৎ শিব |'


ঠাকুরের দেহাবসান হয়েছে | ১৬ অগস্ট, ১৮৮৬ | শ্রীশ্রীমায়ের স্থায়ী কোনো বাসস্থান নেই | ছেলেরা বরাহনগরে ভূতুরে বাড়ীতে ঘোর তপস্যারত | সকলেই মুক্তির পিয়াসী | নরেনও তাই | কিন্তু তাঁর ওপর ভার অনেক, মাথায় প্রবল চাপ | ঘরে মা ভাই বোনেরা ক্ষুধার্ত, পৈত্রিক ভিটা হতে বিতাড়িত | এদিকে রামকৃষ্ণসূর্য আপাত অস্তমিত | কী দোটানা! ক্ষুদ্র স্বার্থ, কর্তব্য একদিকে, অপরদিকে ঠাকুরের বিশ্ববাণীরক্ষা | স্থির করে ফেললেন কর্তব্য | যজ্ঞের যূপকাষ্ঠে বলি দেবেন নিজপরিবার বিশ্বপরিবারকে রক্ষার করার জন্য | নিয়ে ফেললেন সন্ন্যাস |


পরিব্রাজনরত স্বামীজী | ব্রহ্মজ্ঞানী স্বামীজী | নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে, পথে ঘাটে, অরণ্যে পর্বতে, গভীর সমুদ্রে, লোকালয়ে, লোকান্তরে ধ্যানগম্ভীর যতিরাজ | প্রশান্ত ব্রহ্মর্ষি তবু যেন কি নিয়ে সদা ভারাক্রান্ত | একজন জিজ্ঞাসা করে বসলেন, "স্বামীজী, আপনি তো প্রাপ্তপুরুষ | কি নিয়ে দিনরাত এত ভাবেন? যেন কি এক দুশ্চিন্তা!" স্বামীজী স্মিত হেসে বললেন, "দেখ, আমার গুরুদেব এই দেশের ভার আমার কাঁধে তুলে দিয়ে গেছেন | আমি ভেবে পাই না কি ভাবে এই গুরুভার বহন করব, কি ভাবে এই দেশটাকে জাগাব | এই চিন্তায় দিনরাত ডুবে থাকি |" শ্রোতা বুঝলেন কিনা জানিনা, অন্তরালে বিধাতা অবশ্যই বুঝলেন, কাজ হয়েছে, "তুই করবি না কি রে, তোর হাড় করবে | ... এখন এই দেখিয়ে দিলেন মা তোকে সব | এখন মায়ের কাজ কর | চাবি আমার কাছে রইল | কাজ ফুরোলে খুলে দেব দোর সমাধির |"


নরেন্দ্রনাথ দত্ত স্বামী বিবেকানন্দে রূপান্তরিত হলেন |


রচয়িতা: সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment