Sunday 26 January 2020

রাজা মহারাজ ও সুভাষচন্দ্র



রাজা মহারাজ ও সুভাষচন্দ্র
-------------------------------------

প্রজাতন্ত্র দিবসে রাজা মহারাজের (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) আশীর্বাদ ভিক্ষা করি যিনি বালক সুভাষচন্দ্রকে স্বদেশসেবার পথনির্দেশ দিয়ে সন্ন্যাসগ্রহণ হতে বিরত করেন ও অমোঘ আশীর্বাদে জীবন ভূষিত ও ধন্য করেন | সেই মহাপুরুষের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র পরবর্তিকালে ভাববিহ্বল হয়ে বলেন যে যিনি আশীর্বাদ পেয়েছেন, তিনিই জানেন তার যাথার্থ | স্বদেশের মুক্তিকল্পে তাঁর যে সুদীর্ঘ পথপরিক্রমণ, ব্রহ্মানন্দ আশীষই তাঁর ছিল সর্বোচ্চ দিঙনির্দেশক |

জানকীনাথ বসুর বিশেষ পরিচিত স্বামী ব্রহ্মানন্দ সেদিন ছিলেন কাশী সেবাশ্রমে | সন ১৯১৪ | গ্রীষ্মের ছুটিতে বন্ধুবর হেমন্তকুমার সরকারের সাথে বেরিয়ে পড়েছিলেন তীর্থে তীর্থে সদ্গুরুর সন্ধানে | আধ্যাত্মিকতার প্রথম উন্মেষকালে সেদিন কিশোর সুভাষ উত্তরভারতে বহু তীর্থ পরিক্রমা করে গুরুদর্শনে ব্যর্থকাম হয়ে শেষে কাশীতে এসে পৌঁছান | এবার নেতাজীর ভাষায় : "কাশীতে এসে রামকৃষ্ণ মিশনের মঠে গেলে স্বর্গত স্বামী ব্রহ্মানন্দ আমাদের স্বাগত জানান ; তিনি আমার পিতা ও আমাদের পরিবারকে খুব ভাল করেই চিনতেন |"

বহু বছর পর বন্ধু ও সহপাঠী দিলীপ কুমার রায় যখন সুভাষকে স্বামী ব্রহ্মানন্দের স্মৃতিকথা শোনাচ্ছিলেন তখন ভাবাপ্লুত এই বীরবিপ্লবীর দুচোখ জলে ভরে ওঠে ও দিলীপের দুটি হাত ধরে তিনি বলেন : "যে কৃপা পায় তার জীবন বদলে যায় | আর আমিও পেয়েছি এ কৃপার আভাস | তাই তো চাই দেশের কাজে জীবন ঢেলে সার্থক হতে | এও তোমাকে বলছি, ওই রাখাল মহারাজই (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) আমাকে কাশী থেকে ফিরিয়ে দেন | বলেন, আমাকে দেশের কাজ করতে হবে |"

বিপ্লবী নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন : "কৈশোরে পেলেন স্বামীজীর বাণীমন্ত্র | স্বামী ব্রহ্মানন্দ দিলেন অনাগত জীবনের পথনির্দেশ | সদ্গুরুর খোঁজে যখন সুভাষ উত্তরভারতের নানাস্থান ঘুরে কাশীধামে এসেছিলেন, তখনই তাঁর সাক্ষাৎকার ঘটে স্বমী ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে | পিতা জানকীনাথ ছিলেন ব্রহ্মানন্দের প্রিয়জন | পরিচয় পেয়ে এবং সুভাষের মনোভাব জেনে ব্রহ্মানন্দ স্বামী সুভাষকে সস্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিলেন, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন ঘরে ফিরে যেতে |সুভাষের জন্য ভাবী বিচিত্র জীবন অপেক্ষা করে আছে -- এমন কথাও বলেছিলেন | বিরাগী সুভাষ তাঁর কথা শিরোধার্য করেই সেদিন সন্ন্যাস গ্রহণের প্রচণ্ড আবেগ প্রশমিত করে ঘরে ফিরেছিলেন | ... ১৯৩৯ সালে জেলখানায় ... স্বামী ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কথা বলেছিলেন | ... আমি (নরেন্দ্রনারায়ণ) জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "(স্বামী ব্রহ্মানন্দ আপনাকে ঘরে ফিরতে বলেছিলেন, আপনার ...) বাবার কথা ভেবে, অর্থাৎ, ঘরে পাঠিয়ে দিতে পারলে বাবা খুশি হবেন, এই একটা দিক, অন্যটি হল, স্বামী ব্রহ্মানন্দ আপনার আজকের এই জীবন সেদিনই জানতে পেরেছিলেন | এ দুটোর কোনটা সত্য?" "দুটোই সত্য," সুভাষ বলেছিলেন | "বাবার কথা একেবারে ছিল না, একথা আমি বলব না | কিন্তু আমি যোগের শক্তি বিশ্বাস করি |ঠাকুর রামকৃষ্ণ অমনি-অমনি রাখাল রাখাল করতেন না |ওঁর (ব্রহ্মানন্দের) বিশেষত্ব স্বীকার করে নিলে বোঝা যাবে কেন আর সকলকে রেখে রাখালকেই বিবেকানন্দ মিশনের সভাপতি করেছিলেন |"

সুভাষচন্দ্রের আজীবন এই আধ্যাত্মিক পিপাসাই তাঁকে স্বদেশমুক্তির বিশেষ কর্মযজ্ঞে প্রণোদিত করে ও বিবেকানন্দ-ব্রহ্মানন্দ নির্দেশিত পথে স্বীয় লক্ষের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করে | প্রজাতন্ত্র দিবসের পুণ্যলগ্নে আজ এই ত্রয়ীর চরণে প্রণাম |

রচয়িতা ও লিপিকার : সুগত বসু (Sugata Bose)

তথ্যসূত্র : বিবেকানন্দগতপ্রাণ নেতাজী সুভাষ -- লেখক, স্বামী বিদেহাত্মানন্দ

No comments:

Post a Comment