Tuesday 6 July 2021

বন্দে মাতরম ... ২


বন্দে মাতরম ... ২


দেশের আজ ঘোর বিপদ | বৌদ্ধিক বিপর্যয় | অধঃপতিত বৌদ্ধ আচার আচরণ আজ নবকলেবরে নব্যহিন্দুধর্মরূপে পুনঃপ্রকাশিত জাতিয় জনজীবনে | বিবেকানন্দ বিস্মৃত | বেদান্ত নামমাত্র বিদ্যমান | তার প্রয়োগ পরিলক্ষিত নয় ব্যাপকভাবে | পটপূজার প্রাবল্যে মহাপুরুষের জীবনবেদ অবহেলিত | সত্যধর্ম, মানবধর্ম আজ কপটাচারে, ভ্রান্তিতে, দুর্বলতায় আচ্ছন্ন, আবৃত | শিক্ষার অবনমনে সংস্কৃতি বিপন্ন | সভ্যতা চূড়ান্ত সঙ্কটে |


উপায় একমাত্র শিক্ষা | জনশিক্ষা বহুলমাত্রায়, ব্যাপকবিস্তারে এই সাংস্কৃতিক অধঃপতন রোধ করতে সমক্ষ হবে বলে বিশ্বাস | কিন্তু তা যথার্থ শিক্ষা হওয়া চাই, মানুষ গড়ার শিক্ষা, আধুনিককালের স্বার্থবুদ্ধির পরিপোষণকারি শিক্ষার নামান্তর নয় | যে শিক্ষা মানুষকে গভীর করে, যথাযথ ভাবপ্রদানপূর্বক তাকে মনুষ্যত্ব প্রদান করে, হৃদয়কে প্রেমে বিস্তৃত করে, বুদ্ধিকে করে পরিশীলিত, সেই শিক্ষার বহুলবিস্তারে জনসাধারণের যথার্থ কল্যাণ সম্ভব, দেশের অগ্রগতি নিহিত |


কে দেবে এই শিক্ষা ? কার আছে এই সংস্কৃতি যা রোধ করতে পারে সামাজিক অবক্ষয় ও নতুন পথে পরিচালিত করতে পারে জনজীবনকে উন্নতমার্গে ? যাঁরা শিক্ষা দান করেন তাঁরাই আজ বৈশ্যযুগের বাণিজ্যিক মনোভাবাপন্ন, বিজ্ঞাপনের বিষয়ের ন্যায় পন্য | কি দেবেন তাঁরা ? আগের দিনের শিক্ষকদের আদর্শ ছিল, চরিত্রবল ছিল যা ছিল শিক্ষার্থীর অনুকরণের,অনুসরণের, অনুপ্রেরণার বিষয় | এখন তো শিক্ষক শিক্ষিকাই আপন মহিমাকীর্তনে অথবা আপন বৈশয়িক স্বার্থরক্ষায় নিমজ্জিত | যুগের হাওয়া, করেন কি ? কে নেবে ভার আগামি প্রজন্মের সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ? আজ সেই গোড়ার সমস্যায় ফিরে গেছি আমরা যা স্বামীজীকে সে যুগে ভাবিয়ে তুলেছিল | চরিত্রবান যুবকযুবতীর একান্ত আবশ্যকতা আজ সর্বোপরি, ঠিক স্বামীজীর সময়ে যেমনটি ছিল | অর্থাৎ, স্বাধীনতা সংগ্রামের সাময়িক উত্থানের পর পুনরায় অধঃপতন হয়েছে সমাজের | এর অবশ্য পরিসংখ্যানগত কিছু কারণও আছে |


স্বাধীন ভারত সুযোগ এনে দিয়েছে সর্বসাধারণের উন্নতির | শিক্ষার প্রসারের দ্বারা সাধারণের ভিড় বেড়েছে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ও জাতিয় জীবনের সকল কর্মস্থলে যার ফলে সর্বক্ষেত্রেই সাংস্কৃতিক মান নেমে গেছে | এটি নিছক পরিসংখ্যান তত্ত্বের দ্বারাই বোঝা যায় | কাল চার যুগে বিভক্ত -- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র | ক্ষত্রিয়যুগের সাংস্কৃতিক চূড়ান্ত উন্নতির পর বৈশ্যযুগে এর অবনতি ঘটে থাকে, পরিসংখ্যানগত কারণ এর অন্যতম | সাধারণের বৈষয়িক উন্নতি ঘটে বৈশ্যযুগে এবং অনিবার্য কারণে সাংস্কৃতিক অবনতি ঘটে | এরই প্রতিফলন আজ সমাজে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত |


এখন প্রশ্ন হল কি ভাবে রোধ করা যায় এই সাংস্কৃতিক অবনতি | আগেই বলা হয়েছে যে আপামর জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলাই এর একমাত্র সমাধান | সেই সুবৃহৎ পরিকল্পনা প্রয়োগের মাঝে অসাধারণ ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ অবদানের দ্বারাই এই সামাজিক ঊর্দ্ধগমন সম্ভব, নচেৎ নয় | সমষ্টি ও ব্যষ্টির সম্মিলিত প্রয়াসেই এই পরিবর্তন সম্ভব | তাই সর্বাগ্রে চাই কিছু চরিত্রবান, বুদ্ধিমান, হৃদয়বান, স্বার্থত্যাগী, মানবপ্রেমী, দেশপ্রেমী মানুষ | এঁদের দ্বারাই এই মহাযজ্ঞ সম্পন্ন হবে | এই সমস্যার এরূপ সমাধানই করেছিলেন স্বামীজী |


কিন্তু বলা এক আর করা আর এক | ইতিহাস রচিত হয় তার সীমারেখার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েই | এমন কি ইতিহাসের আপন সীমা অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে নব অধ্যায়ের সূচনাও হয় বিবর্তনের দুর্লঙ্ঘ নিয়ম পালনের মধ্য দিয়েই | ছাড়পত্র রয়েছে কিন্তু যথেচ্ছ নয় | তাই যুগান্তকারি পরিবর্তনও আসে সেই ছাড়পত্রের বিধি মেনে | অগ্রগতির এই বিধান | যাঁরা সমাজসচেতন, যাঁরা মানুষের কল্যাণকর্মে ব্রতী, তাঁরাও এই নিয়মের আবেষ্টনে বন্দি থেকেই তাঁদের প্রচেষ্টা চালান | প্রশ্ন হল এই -- বাধ্য হয়ে, ভবিষ্যতের বৃহত্তর স্বার্থরক্ষার্থে আপোস না কি বর্তমান শোষণ ব্যবস্থার সুবিধালাভের জন্য আপোস ?


মহাপুরুষ আসেন, বাণী দেন, কিন্তু তাঁর অনুগামীরা তাকে রূপদান করতে গিয়ে শাসকশ্রণীর সাথে আপোস করে বসেন ও তদ্বারা যুগস্রষ্টার বাণীরূপের ব্যভিচার হয় | এরই ফলে সমাজে শোষণ চলতেই থাকে | বিবর্তনের চক্রে ইতিহাস তার যথাযথ কালক্রমণ না করা পর্যন্ত কোন বাণীই ফলদায়ী হয় না | তাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় আমাদের, কোনও মহাপুরুষসংগঠিত সঙ্ঘের সামর্থ নেই এই মহাপরিকল্পনাকে রূপদান করার |


কর্ম দূরুহ, মহাযজ্ঞ, যাকে যথার্থই পালনীয় ধর্ম বলা যেতে পারে | মহাপুরুষের বাণীকে আদর্শ করে তার রূপায়ণের পন্থা খোঁজা ও তাকে বাস্তবে পরিণত করে সর্বসাধারণের জীবনযাত্রাকে উন্নীত করা, এই হল যুগধর্ম, এই যুগসমাজবিজ্ঞান | নিছক আবেগের দ্বারা কোনও কিছুই সাধিত হবে না যদিও উৎসাহ, আবেগ, দুইই চাই, কিন্তু বিজ্ঞানের দ্বারা নিয়ত্রিত হতে হবে তার কর্মপ্রকাশ | কালক্ষেপণ, ধৈর্য্য, অধ্যবসায় ও বিজ্ঞানমনস্কতা -- এই সকল বৃত্তিসহায়ে সম্ভব সমাজের কুব্যবস্থা দূর করে তাকে সুসংস্কৃত করা যাতে শোষণ অপসারিত হয় ও সর্বসাধারণ যোগ্যতা অনুসারে যথার্থ জাতিবিন্যস্ত শ্রেণীহীন সমাজে সুখে জীবনযাপন করতে পারে | ব্যবহারিক সুযোগসুবিধা প্রাপ্ত হলে পর মানুষের আধ্যাত্মিক মুক্তির বিকাশের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে | 


বস্তুবাদ যা অধ্যাত্মবাদকে অস্বীকার করে, তা নিন্দনীয় | কিন্তু বস্তুবাদ যা অধ্যাত্মবাদের পরিপূরক, তা অবশ্য বরণীয় | এই দুই বাদের পরস্পর কোন বিরোধ নেই বেদান্তবিচারে কিন্তু প্রয়োগে প্রায়ই দেখা যায় বিস্তর বিরোধ | এর কারণ মানুষের খণ্ডজ্ঞান ও স্বার্থবুদ্ধি যার প্ররোচনায় এই দুই মতাবলম্বির মধ্যে সংঘাত |


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)

No comments:

Post a Comment