Wednesday 12 June 2024

বেশ কথা


বেশ কথা

☆☆☆☆☆


আমাদের দেশে অধিকাংশই দরিদ্র | তাঁরা দুমুঠো অন্নের জন্য আজও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন, তবু দিনগুজরান যথাযথ হয় না | তাঁদের বেশভূষা মলিন, ছিন্নপ্রায়, অনাড়ম্বর | দেশের নেতা এই দরিদ্র জনসমূহ হতেই উঠে এসেছেন | একদিন তিনি ট্রেনে চা বেচতেন | পরে বিবাহপশ্চাৎ গৃহত্যাগ করে বছর দুয়েক হিমালয়ে পরিভ্রমণ করেন আধ্যাত্মিক অভীপ্সায় | রামকৃষ্ণ মিশনে যোগদান করার প্রয়াসে ব্যর্থ হন ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে যোগদান করেন | সেখানকার আদর্শ, নিয়মানুবর্তিতা ও জীবনধারণের সারল্য তথা কৃচ্ছে অভ্যস্ত হন | স্ত্রীসঙ্গবিবর্জিত সংঘপ্রচারক হন ও সংঘের নানা কাজে কয়েক দশক কাটিয়ে দেন | পরে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ও পরিশেষে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীরূপে নিজেকে চিহ্নিত করেন, জনমানসে মুদ্রিত হন ও দেশে বিদেশে খ্যাতি লাভ করেন | 


কৈশোর হতেই বেশভূষার প্রতি সৌখিন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি | তখন অর্থানুকূল্য ছিল না, এখন হয়েছে | তখন প্রতিপত্তিহীন ব্যক্তিটি ধোয়া, ইস্তিরি করা, পরিষ্কার জামা কাপড় পরতেন আর আজ প্রবল প্রতিপত্তিশালী প্রধানমন্ত্রী নিজ অপূর্ণ বাসনা পূর্ণ করার অভিলাশে নিত্য নতুন নানা বর্ণের বিবিধ বেশে নিজেকে ভূষিত করে চলেছেন | এই গেল গত দশ বছরের হিসেব | 


এখন এই নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে মোদিজীর যে তিনি কেমন করে এরকম বেশভূষার বৈভব পছন্দ করেন যেখানে কোটি কোটি দেশবাসীর গায়ে দেবার কাপড় পর্যন্ত পর্যাপ্ত নেই | ইংরেজি প্রবাদবাক্য শুনেছি আজন্ম : Simple living, high thinking. স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি কিনা নরেন্দ্র মোদির আদর্শপুরুষ, তিনিও বলেছিলেন যে তিনি dandy, অর্থাৎ, অতিশয় শরীরী বেশবিন্যাসে যত্নবান, পছন্দ করতেন না | স্বামীজী স্বাদেশিকতার চূড়ান্ত আজ্ঞায় বলেছিলেন, "তুমিও কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া সদর্পে ডাকিয়া বল ... |" গান্ধীজী সেই বেশভূষার জ্বলন্ত প্রতীক | অবশ্য, অবস্থা বদলেছে, পরিস্থিতি স্বতন্ত্র এখন, পদ ভিন্ন, তাই সেই বেশই যে পরতে হবে এমন নয় | কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ যা পরেন না, ক্রয় করতে সমর্থ নন, সেই মহার্ঘ্য বস্ত্র পরা কতটা সমীচীন তা বিবেকবান মানুষমাত্রেই উপলব্ধি করবেন | এ নিয়ে তর্ক চলে না | এ রুচির ব্যাপার, হৃদয়বত্তার বিষয়, সহানুভূতির বস্তু |


প্রশ্ন উঠতে পারে, নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী প্রমুখও তো সুবেশিত, সুবিন্যস্ত থাকতেন | তাহলে মোদির বেশভূষায় আপত্তি কোথায় ? আর বেশভূষাই দেখছেন, কাজ দেখছেন না ? কিন্তু RSSএর প্রাক্তন প্রচারকের এই পরিবর্তন ? এটাই বোধ হয় অনেকের বিসদৃশ লাগছে | তবে রজোগুণী প্রধানমন্ত্রীর বেশভূষা রজোগুণীরই মত হবে, এতে আর আশ্চর্য কি ? এখন তো আর তিনি পরিব্রাজক হিমালয়যাত্রী নন যে দরিদ্রের বেশ পরবেন | এখন তিনি বিকাশের বার্তাবহ, বিকাশের অধিকর্তা, বিকশিত ভারতের প্রতিভূ | তাই বিকশিত বেশবাস |


মোদিজীর কাজ কি কোনভাবে ব্যাহত হয়েছে এযাবৎ তাঁর বেশভূষার পারিপাট্ট, এমনকি বিলাসের দ্বারাও ? নাকি তা বিন্দুমাত্র হয়নি | অবশ্য, বুঝব কি করে আমরা ? কিভাবে মাপব কাজের সময় কতটা দিলেন, মনের শক্তি কতটা ব্যয় করলেন শারীরীক পারিপাট্ট বজায় রাখতে | রাজা তো রাজবেশই ধারণ করেন | তাতে তো কোনও কথা ওঠে না তাঁর কর্মে অবহেলাবিষয়ক | সামরিক বাহিনীতেও তো পোশাক পরিচ্ছদ সব টিপটপ | তাতে তো কর্মেও পরিচ্ছন্নতা আসে ও কর্ম আরও সুচারুরূপে সম্পাদিত হয় | হয়ত ওই রকমই মোদিজীরও বেলায় প্রযোজ্য | তাঁর হয়ত সুন্দর বেশভূষায় পরিহিত হলে কর্মক্ষমতা বাড়ে | এটা হয়ত তাঁর comfort zone. ঠাকুরের ভাষায়, "যার যা পেটে সয় |" তাহলে আমাদের সইছে না কেন ? এর কারণ কি এই যে আমাদেরও সুপ্ত বাসনা মোদির মত পরিধান পরি ? কিন্তু অর্থে কুলোয় না, তাই রাগ |


বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রুচি | বস্ত্রাবরণও সেই রুচির অন্তর্গত | মোদিজীর ভাল লাগে সাজগোজ করতে | অনেকেরই হয়ত তা ততটা ভাল লাগে না | তাঁদের হয়ত ভাব এই যে দরিদ্র দেশের দরিদ্র জনসাধারণের প্রধান প্রতিভূ তাঁর দেশবাসীর প্রতি সহমর্মিতায় তাঁদেরই মত সাধারণভাবে আহারবিহার করবেন | এটা সংগত চিন্তা বটেই কিন্তু এমনটা মোদিজীর ক্ষেত্রে হয়নি | সেইখানেই তাঁদের ক্ষোভ | তা আর কি করা যাবে ? মোদিজীর জনপ্রিয়তা এই হেতু হয়ত অল্পবিস্তর কমবে | তা নিয়ে কি তিনি ভাবিত ? মনে হয় না | অতএব, ওই কথাই বজায় রইল --- "যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ |" এখন লাভক্ষতির হিসেব বসে বসে করুন আপনারা কারণ মোদির তো মন বেশ মজেছে বেশে | এর শেষ কোথায় ? বিচার আপনাদের |


রচয়িতা : সুগত বসু (Sugata Bose)


আলোকচিত্র : সৌজন্যে The Sunday Guardian

No comments:

Post a Comment